
বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বলা হয়
স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনা করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে এ কথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু যে কত আন্তরিক ছিলেন উপরের ভাষ্য থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়
বাংলা ভাষা : বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বলা হয়। এই ভাষার উৎপত্তি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই ভাষার উৎপত্তি হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বছর আগে। বাংলা ভাষা হলো ইন্দো-আর্য ভাষা। এই ভাষাটি ব্যবহার করে থাকে প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতি। চর্যাপদ এই ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলা ভাষার লিপি হলো বাংলা লিপি।
বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম বহুল ব্যবহৃত ভাষা। এটি বাংলাদেশের মাতৃভাষা হলেও বিশ্বম-লে এমন দেশ পাওয়া কঠিন, যেখানে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় না। বিশ্বজুড়ে ৩৫ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। যার মধ্যে ২৬ কোটির বেশি বাংলা ভষাভাষী মানুষ বাংলাদেশ ও ভারতে বসবাস করেন। বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী বাকি ৯ কোটির বেশি মানুষ ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলা ভাষা প্রধানত ব্যবহার করা হয় বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, ওড়িশায়।
ওড়িয়া, অসমিয়া এবং বাংলা ভাষা একই উৎস থেকে এসেছে। পরবর্তীকালে প্রথমে ওড়িয়া এবং পরে অসমিয়া আলাদা হয়ে গেছে এই উৎস থেকে। এই কারণেই বাংলা ভাষা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন ‘চর্যাপদ’কে অসমিয়া এবং ওড়িয়া ভাষা সাহিত্যেরও উৎস বলে মনে করা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশের মানুষের মুখ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। অথচ এখনো সেই দেশেও রয়েছেন বহু বাংলাভাষী মানুষ। পাকিস্তানের কারাচিতে প্রায় ২১ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। করাচি সিটি করপোরেশনের অন্যতম দাফতরিক ভাষাও বাংলা।
ব্রিটেনে স্বীকৃত পঞ্চম অভিবাসী ভাষা বাংলা। সেখানে প্রায় ৮ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার ১% বাংলা ভাষাভাষী। মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও আছেন প্রচুর পরিমাণ বাঙালি অভিবাসী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকাÑ কোথায় নেই বাঙালি! যেখানেই বাঙালি সেখানেই বাংলা ভাষা প্রচলিত। লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, নিউইয়র্ক ইত্যাদি শহরে বাংলা সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিও সম্প্রচার, বাংলা শিক্ষালয় ইত্যাদি রয়েছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শেখানো হয় এবং বেশ কিছু বাংলা রেডিও সম্প্রচার হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তথ্য সূত্র বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে সংকলিত।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা : আমার বন্ধু-সহপাঠী ও সহকর্মী মুহম্মদ জালালের একটি বই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। এখনো রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আমার বিভাগ থেকে বাংলা ব্যবহারের জন্য নতুন করে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উপসচিব স্বাক্ষরিত এই স্মারকপত্রে ১৪.০০.০০০.০০১.০১৬.০৮০.১৭,১৭৬ বিভাগের সকল কাজে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, এর আগে বঙ্গবন্ধু সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এরপর বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন ১৯৮৭ প্রণীত হয়েছে (৮৭ সালের দুই নম্বর আইন) যাতে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনের তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।
(২) ৩ (১) উপ-ধারায় উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।
(৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ বলা বাহুল্য, এই আইনটি সংবিধানের তিন নম্বর অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত।
বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার জন্য তাঁর জীবনটাই উৎসর্গ করেন। ছোট্ট করে তাঁর কিছু ভাবনা-চিন্তা এখানে তুলে ধরতে পারি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ‘আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি আমার প্রাণের মাটি; বাংলার মাটিতে আমি মরবো, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি ও সভ্যতা।’
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেনÑ ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না।
পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে জানে না এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন, দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’
১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেন, ‘আমরা ইংরেজি বলতে পারবো, তবে বাংলাতেই আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যদি পরিষদে আমাদের বাংলায় বক্তৃতার সুযোগ না দেওয়া হয় তবে আমরা পরিষদ বয়কট করবো। বাংলাকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করবো।’
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের প্রাক্কালে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য, ১৯৫২ সালের মতো যে কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে বাঙালিকে আহ্বান জানান।
১৯৬৯ সালের এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ভাষা-ভাবনার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেনÑ ‘পাকিস্তানের সর্ব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলন করিতে হইবে এবং পাকিস্তানের সরকারী ও বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক জীবনে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের জন্য কার্যকরী উৎসাহ প্রদান করিতে হইবে এবং সকল প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।’
স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনা করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আদালতের রায় বাংলা ভাষায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যথাযথ পরিভাষা না থাকার কারণেই রাষ্ট্রের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিতে পারে এ কথা অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু যে কত আন্তরিক ছিলেন উপরের ভাষ্য থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।
অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ : উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ-এর নিবন্ধ থেকে নেওয়া
৯ অক্টোবর ২০২৩
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
[email protected]
w.bijoyekushe.netww
w.bijoydigital.com