ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

সিঙ্গাপুর কেন এগিয়ে

​​​​​​​ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২২:০৫, ১৩ আগস্ট ২০২৩

সিঙ্গাপুর কেন এগিয়ে

.

এশিয়ার চার বাঘ’-খ্যাত দেশগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। বাকি তিন দেশ হচ্ছেহংকং, দক্ষিণ কোরিয়া তাইওয়ান। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির ্যাংকিংয়ে সিঙ্গাপুর শুধু হংকং, তাইওয়ান দক্ষিণ কোরিয়াকেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ, এশিয়ার ওভাররেটেড টাইগার এখন শুধু সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিস্ময়কর। অর্থ, শিক্ষা প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশটি হয়ে উঠছে আধুনিক থেকে আধুনিকতর। পর্যটন   চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। দ্বীপ দেশটির নাম সিঙ্গাপুর কিভাবে হলো তার একটি ছোট্ট ইতিহাস রয়েছে। সিঙ্গাপুর শব্দটি এসেছে মালয়েশিয়ান শব্দসিঙ্গাপুরাথেকে। সিঙ্গা শব্দটি হচ্ছে সংস্কৃতি শব্দ, যার অর্থ সিংহ। সিঙ্গাপুর শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় সিংহের শহর। তবে মজার বিষয় হলো সিঙ্গাপুরে কোনো সিংহ নেই।

চাকরির সুবাদে বেশ কয়েকবার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করি আর তখনই তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। রাতের জীবন, রেস্তোরাঁ, সাংস্কৃতিক আবহ সব  মিলিয়ে একটি ঝকঝকে তকতকে যানজটমুক্ত আধুনিক শহর। সম্প্রতি বিশ্বের সেরা শহরগুলোর অন্যতম সেরা শহর হিসেবেও তালিকায় নাম উঠে এসেছে দ্বীপ দেশটির। সর্বোচ্চ গুরুত্ব হিসেবে স্থান পেয়েছে, ‘করাপশন ফ্রি কানট্রি অত্যাধুনিক বিমান বন্দর, যা বর্তমান বিশ্বে সৌন্দর্যের দিক থেকে প্রথম স্থানে, সুবিন্যস্ত পর্যটন, বিনোদনসহ আর রয়েছে দারুণ সব শপিংমল। নাগরিক সেবাও অভূতপূর্ব। আইনশৃঙ্খলা এতটাই কঠোর যে, রাস্তাঘাটে ময়লা ফেলা তো দূরের কথা, চুইঙ্গাম খেলেও জরিমানা গুনতে হয়। এসব উন্নয়নের পেছনে যার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি হলেন আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা মি. লি. কুয়ান ইউ। বলতে গেলে যে দেশের তেমন কোনো সম্পদই ছিল না, সেখান থেকে টেনে তুলে এমন সিঙ্গাপুর তিনি নির্মাণ করেছেন, যা এখন বাকি বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

সিঙ্গাপুরের সরকারি নাম রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুর। আয়তন মাত্র ৭২৮ বর্গ কিলোমিটার এবং  লোকসংখ্যা ৫৭ লাখ ৩৬ হাজার। অল্পসংখ্যক জনগণের মধ্যে ৭৭ ভাগ চাইনিজ, ১৫ ভাগ মালয়ি এবং ভাগ ভারতীয়। প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হয় ইংরেজি ভাষা। সিঙ্গাপুরের মুদ্রার নাম সিঙ্গাপুরী ডলার। বছরে মাথাপিছু আয় ৫৬,৩২০ ইউএস ডলার, যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, তাদের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড কতটা উঁচুমানের। সিঙ্গাপুরে রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম তেল শোধনাগার। অপরিশোধিত তেল কিনে তা পরিশোধন (Refine) করে বিভিন্ন দেশে রি-এক্সপোর্ট করা হয়। ছাড়াও রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সীপোর্ট। করাপশন ফ্রি কানট্রি হওয়ায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসছে। কৃষিতে তেমন উন্নত নয় বিধায় অধিকাংশ খাদ্য সামগ্রী আমদানি করে থাকে।

একসময় সিঙ্গাপুর ছিল মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাসে সিঙ্গাপুরই একমাত্র দেশ যারা কিছুতেই স্বাধীনতা চায়নি। গরিব দ্বীপ দেশ বিধায় মালয়েশিয়ার সাহায্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। মালয়েশিয়া এই বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছিল। অবশেষে ১৯৬৫ সালে টিংকু আবদুর রহমান সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। তখনই সিঙ্গাপুর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। স্বাধীন হয়ে যেন বেকায়দায় পড়ল দ্বীপ দেশটি। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা যে কত কঠিন, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন সিঙ্গাপুরী নেতা মি. লি. কুয়েন ইউ। তিনি ভঙ্গুর দেশটির শক্ত হাতে হাল ধরেন এবং পরবর্তী তিন দশকে সিঙ্গাপুরের চেহারা পাল্টে দেন। এখন মালয়েশিয়ানরা সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এশিয়ার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বন্দর নগরী এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল বিধায় পৃথিবীর বহু খ্যাতনামা কোম্পানির অফিস এখানে অবস্থিত। সারাবছরই টুরিস্টদের আনাগোনা থাকে বলে টুরিজম থেকেও রয়েছে তাদের এক বিশাল  উপার্জন। চায়নিজদের সংখ্যা বেশি বিধায় সিঙ্গাপুরকে চায়না টাউন বললেও অত্যুক্তি হবে না। আয়তন লোকসংখ্যার দিক থেকে ছোট হলেও দেশটির রয়েছে আকাশচুম্বী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি।

সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মি. লি. কুয়ানের হাত ধরেই সিঙ্গাপুরের আধুনিকায়ন শুরু। তিনি ২০১৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে সুযোগ্য সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মি. সিয়েন লং তার মেধা শ্রমের মাধ্যমে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে উন্নয়নের শীর্ষস্থানে পৌঁছে দেন। সিঙ্গাপুরে প্রধানত একটিই পলিটিকাল পার্টি রয়েছে, যাপিপলস অ্যাকশন পার্টিনামে পরিচিত। পার্লামেন্টে মোট ৮৪ টি আসনের মধ্যে ৮৩টি সিট পিপলস অ্যাকশন পার্টির করায়ত্ত। কাজেই সিঙ্গাপুরকে ওয়ান পার্টি স্টেট হিসেবেও অভিহিত করা হয়। সেক্ষেত্রে দেশটিতে প্রকৃত গণতন্ত্র আছে কি-না যুক্তরাষ্ট্রতেও তা নিয়ে বাকবিতন্ডা রয়েছে। তবে নিয়ে ওদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো মাথা ব্যথা নেই। কোনো অভাব অনটন নেই বিধায় সরকারের সকল কর্মকান্ডকেই তারা ভালো চোখে দেখে। তারা মনে করেও সরকার তাদের শুভাকাক্সক্ষী বন্ধু। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুদক্ষ পরিচালনায় অতি অল্প সময়ে দেশটির সকল মানুষ রূপান্তরিত হয়েছে সম্পদ পুঁজিতে।

বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে তাদের জন্মহার কমাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কিছু দেশ জন্মহার বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরও তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে  না। সিঙ্গাপুর এর মধ্যে অন্যতম। দ্বীপ দেশটির জনসংখ্যা  দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। শিশু জন্মহার কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে দেশটির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে বলে মনে করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সক্ষম দম্পতিরাও ক্রমশ কম সন্তান গ্রহণ করছেন। অবস্থা চলতে থাকলে দেশের মূল নাগরিক বিশেষ করে কর্মক্ষম নাগরিকের সংখ্যা কমতেই থাকবে। দেশের ক্রমবর্ধমান শিল্প, বাণিজ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য বহিরাগত দক্ষ লোকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। এটা নিশ্চয়ই সিঙ্গাপুরবাসীর জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

দ্বীপ দেশটির তরুণ-তরুণীরা যাতে বিয়ে এবং বেশি হারে সন্তান জন্মদান করে, সে জন্য সিঙ্গাপুর সরকার প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের ডেটিংয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা পর্যন্ত দেওয়া হয়। সদ্য জন্ম দেওয়া পিতা-মাতাকে বেবি বোনাসসহ আর্থিক, আবাসিক শিক্ষা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এতটা  করার পরও দেশটির শিশু জন্ম হার বাড়ছে না। দেখা গেছে, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বিয়েতে অনীহা প্রকাশ করছে। তারা লিভ টুগেদার করছে। উদার যৌন জীবনযাপন করতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। একে অপরের দায়িত্ব নিচ্ছে না। তারা তাদের উপার্জন নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যয় করছে আরাম আয়েশে। পাশ্চাত্যের হাওয়টা ভালোভাবেই লেগেছে।

অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দ্রুতহারে জনসংখা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে জনসংখ্যার যে বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে, সে তুলনায় শিল্পকারখানার তেমন প্রসার ঘটছে না। বিজ্ঞান প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলেও বেকারদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার অপেক্ষা বেশি হওয়ার দরুন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে কম। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, উন্নত বিশ্বে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীর সংখ্যাও কমছে। অথচ ওসব দেশে কাজের ক্ষেত্র প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশসহ সল্পোন্নত বিশ্বের প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টি দেখলে অনেকটা আশান্বিত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। কেননা, উন্নত বিশ্বের বিশাল কর্মজগতে কর্মীর জোগান দিতে হবে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত বিশ্বকেই।

প্রতিটি মানুষ জন্মগ্রহণ করে শূন্য হাতে। জন্মের পর যখন সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, তখন নিজের প্রচেষ্টায় গুণ অর্জন করে। এই গুণটাই হলো তার দক্ষতা। অর্থাৎ, কর্মজীবনে সফল হতে হলে প্রয়োজন দক্ষতার। সিঙ্গাপুরে দক্ষ শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশটিতে চীন ভারতের লোকসংখা বেশি বিধায় দক্ষতার মাপকাঠিতে এই দুই দেশের লোক শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুরে প্রবেশের সুযোগ সুবিধা বেশি পায়। বাংলাদেশে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে এখনো তারা পিছিয়ে রয়েছে। তাই প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে পেরে উঠছে না। ফলে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে না।

১৯৫৭ সালে সারাবিশ্বে যেখানে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০ কোটি, এখন তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি। এর মধ্যে চীন ১৪০ কোটি নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। ১৩৮ কোটি  নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। তৃতীয় স্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩৩ কোটি ২০ লাখ। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, নাইজিরিয়া বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০৫০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ১০০০ কোটির ঘর পেরিয়ে যাবে। তাদের মতে, বিশ্বের ধারণ ক্ষমতা হলো ৪০০ কোটি। অর্থাৎ, অতিরিক্ত প্রায় ৪০০ কোটি লোক না থাকলে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান হতে পারত। বাস্তবে তা হয়নি। জনসংখ্যা ৪০০ কোটির স্থলে প্রায় ৮০০ কোটি। অর্থাৎ, দ্বিগুণ। তাহলে কী জনসংখ্যা পৃথিবীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে? এর ফলেই কী প্রকৃতিসহ বিশ্বের সর্বত্র বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে?

প্রতিবছর আগস্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করা হয়। দিনটিতে তারা ফিরে এসে জানিয়ে দেয় দেশটির বেড়ে ওঠার গল্প। অতীতকে তারা কখনো ভোলে না। শ্রদ্ধা আর গর্বের সঙ্গে দিনটিকে স্মরণ করে। স্বাধীনতা শব্দটি যে কোনো জাতির জন্য গৌরব এবং মর্যাদার। বহু রক্ত আর প্রাণের  বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা। সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা কিছুটা ব্যতিক্রমী। অর্থাৎ সিঙ্গাপুর হচ্ছে সিনেমার নায়কের মতো, যাকে মালয়েশিয়া ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পর সে কঠোর পরিশ্রম করে পরিণত হলো এক স্বপ্নের মহানায়কে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বুরো বাংলাদেশ

×