
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিজ্জ ভোজ্যতেল যেমন- সানফ্লাওয়ার অয়েল, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল
আমাদের খাবারে ব্যবহার্য তেল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান দেশীয় ও বৈদেশিক বাজারের অবস্থাও বিবেচনা করতে হবে। তবে এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোনোভাবেই আমাদের নির্দিষ্ট কোনো একটি তেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। খাদ্য তালিকাতে সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, অলিভ অয়েল সবটাকেই স্থান দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের গবেষকগণের গবেষণাও আরও জোরদার করা প্রয়োজন
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিজ্জ ভোজ্যতেল যেমন- সানফ্লাওয়ার অয়েল, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, রাইস ব্রান অয়েল, বাটার ওয়েল ইত্যাদি প্রচলিত থাকায় রান্নার জন্য কোন্ তেল ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী হবে তা নির্ধারণ করা বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। যেহেতু তেলের মধ্যে বিদ্যমান চর্বির ধরন ও পরিমাণ বিভিন্ন উৎস ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়, সেহেতু ভোজ্যতেল নির্বাচনের আগে অবশ্যই এর চর্বির ধরন ও পরিমাণ সম্পর্কে জানতে হবে।
তেলে সাধারণত স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বিদ্যমান। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড একটি কার্বন চেইন দিয়ে গঠিত, যার কোনো দ্বি-বন্ধন নেই। যেহেতু ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো কোষ-ঝিল্লির কাঠামোগত একক, সেহেতু স্যাচুরেটেড কনফিগারেশন কোষ-ঝিল্লির তরলতা (Fluidity) হ্রাসে অবদান রাখে।
এছাড়া স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড মানব শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। এগুলো প্রধানত প্রাণিজ চর্বি জাতীয় খাবারের মাধ্যমে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, শরীর ডিনোভো লাইপোজেনেসিসের মাধ্যমে কার্বোহাইড্রেট থেকে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড সংশ্লেষণ করতে সক্ষম। এ কারণে শুধু স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণের বিষয়ে লক্ষ্য রাখলেই হবে না, খাবারে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ ও গুণগত মানের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডসমূহ অ্যাডিপোজ টিস্যুর ইনফ্ল্যামেশনের সঙ্গেও সম্পর্কিত। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডসমূহ সাধারণত প্রাণিজ উৎস হতে আসে।
অন্যদিকে, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের কার্বন চেইনে দ্বি-বন্ধন বা ত্রি-বন্ধন থাকে। কক্ষ তাপমাত্রায় তরল হয়। এটি ভালো কোলেস্টেরল (HDL=high density lipoprotein) বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যদি কেউ হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে চায়, তাহলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিবর্তে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ করতে পারে। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে। এটি খারাপ কোলেস্টেরলের (খউখ) লেভেল কমাতে সাহায্য করে। আনস্যাচুরেটেড আবার পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (polyunsaturated fatty acids =PUFA) যেমন সানফ্লাওয়ার অয়েল , সয়াবিন তেল ও মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (monounsaturated fatty acids =MUFA) যেমন অলিভ অয়েল, সরিষার তেল নিয়ে গঠিত। চটঋঅ আবার স্ফ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও স্ফ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড এ বিভক্ত। কিছু স্ফ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীর নিজের দ্বারা তৈরি করতে পারে না, যার জন্য খাদ্য তালিকায় এটি আলাদাভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এখানে উল্লেখ্য যে, ঐউখ কোলেস্টেরল, খউখ কোলেস্টেলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। ঐউখ এর কণাগুলো রক্তের মাধ্যমে শিরায় ঘুরে ঘুরে ধমনির দেয়ালে লেগে থাকা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কণা ও খউখ কে রক্তে দ্রবীভূত করে ফেলে। ঐউখ কোলেস্টেরলের ঐসকল ক্ষতিকারক উপাদানকে যকৃতে নিয়ে রিসাইকেল করে। তাই খাদ্যতালিকায় আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল ব্যবহার করতে হবে।
রান্নার জন্য তেলে বিদ্যমান ফ্যাট সম্পর্কে ধারণা রাখার পাশাপাশি তেলের ওপর তাপমাত্রার প্রভাব সম্পর্কে জেনে রাখা জরুরি। উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করার পদ্ধতি (ফ্রাই,ডিপ ফ্রাই) তেলের অভ্যন্তরীণ ভাঙন ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল যেমন পারঅক্সাইড, অ্যালডিহাইড নির্গমন করে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ অয়েল যেমন সানফ্লাওয়ার অয়েল, তিসি তেল উচ্চ তাপমাত্রায় পরিবর্তনশীল। সে ক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রা রান্না পদ্ধতিতেই তেলগুলো ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। অপরদিকে হালকা ফ্রাই, বারবিকিউ, বা রান্নার জন্য কম পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ অয়েল যেমন অলিভ অয়েল, রাইস ব্রান অয়েল, ক্যানোলা অয়েল ব্যবহার করা ভালো।
এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তেলের স্মোক পয়েন্ট। অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় তেল পুড়ে ফ্যাটগুলো ভেঙে যায়, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই কতক্ষণ ধরে রান্না হচ্ছে, সেটা বেশ জরুরি। যেমন, আজকাল অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতনতায় অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল খেয়ে থাকেন। কিন্তু অলিভ অয়েলের স্মোক পয়েন্ট অনেক কম হওয়ায় ভাজাপোড়ার ক্ষেত্রে এই তেল উল্টো ফল দিতে পারে। অলিভ অয়েল দিয়ে ১৭ মিনিটের বেশি সময় ধরে রান্না করা ঠিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত বেশিরভাগ খাবার রান্না করতে এর চাইতে অনেক বেশি সময় লাগে, ফলে, তেল তার কার্যকারিতা হারায়। তাই অলিভ অয়েল খেতে হলে সেটা খাবারে সরাসরি মিশিয়ে খেতে হবে। যেমন- সালাদের ড্রেসিংয়ে কিংবা খাবার অল্প আঁচে দ্রুত রান্না করে ফেলতে হবে।
এক্ষেত্রে বেশি সময় ধরে রান্নার জন্য উপযোগী হলো অন্যান্য ভার্জিন বা রিফাইন্ড তেল। এগুলোর স্মোক পয়েন্ট তুলনামূলক বেশি থাকে। সরিষা তেল, সয়াবিন তেল বা বাজারে প্রচলিত অন্যান্য তেল রান্নার সময় সহজে ভেঙে যায় না। সম্প্রতি রান্নার জন্য নারিকেল তেলকে বলা হয়েছিল সুপার ফুড। তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এই তেলকে ‘খাঁটি বিষ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। কারণ, নারকেল তেলের ৯০ শতাংশই স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাট।
আবার পোড়া তেল শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। কারণ, বারবার তেল পুড়লে নতুন বিক্রিয়ায় রাসায়নিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে ইউরিক অ্যাসিডসহ বহু বিষাক্ত উপাদান তৈরি হয়, যা থেকে হার্টের ক্ষতি হতে পারে। তাই পুষ্টিবিদরা বলছেন, পরিমিত তেলে ভাজা খাবার খেতে হবে। অনেক তাপে অনেকক্ষণ ধরে রান্না করা এড়িয়ে যেতে হবে। ব্রিটেনের ডি মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেস্টার স্কুল অব ফার্মাসি এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে যে, উচ্চ তাপমাত্রায় (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি) রান্না করলে তেল-চর্বিতে থাকা অনুর গঠন বদলে যায়। বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বা অক্সিডেশন হয়। সেখান থেকে উৎপন্ন হয় অ্যালডিহাইডস এবং লিপিড পার অক্সাইড।
অ্যালডিহাইডস নিশ্বাস বা খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলেও সেটা হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। গবেষকদের মতে, সূর্যমুখী তেল ও ভুট্টার তেলে উচ্চতাপে রান্না করলে অনেক বেশি হারে অ্যালডিহাইডস উৎপন্ন হয়। তবে অল্প তাপে অল্প সময়ের জন্য রান্না করলে আতঙ্কের কিছু নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আবার মাখন প্রাণিজ ফ্যাট হলেও এতে অ্যালডিহাইডস উৎপন্নের মাত্রা অনেক কম। এক্ষেত্রে গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, সম্ভব হলে টিস্যু বা শোষক কাগজ দিয়ে ভালোভাবে ভাজা খাবারের তেল ছেঁকে খেতে হবে। তরকারির ওপরে তেলের আস্তর তুলে ফেলে দেওয়া যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তেলে চর্বির পরিমাণ এক হলেও ক্যালোরি ও ফ্যাটি অ্যাসিডে হালকা তারতম্য হয়। যা অন্য খাবার দিয়ে পূরণ করে নেওয়া সম্ভব। তাই, কোন্ তেল খাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে সেটার জন্য জরুরি বিষয় হলো তেলটি কতটুকু খাওয়া হবে এবং কিভাবে খাওয়া হবে।
তাছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাবার উপযোগী তেল বাছাইয়ের পূর্বে দেশের বর্তমান ভোজ্যতেল পরিস্থিতি, বিশ্ববাজারের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করা জরুরি। আমাদের দেশে তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন ও সূর্যমুখী প্রভৃতি চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সরিষা, তিল এবং সূর্যমুখী থেকেই সাধারণত তেল বানানো হয়। গত ২০২১-২২ মৌসুমে প্রায় ৮.৬ লাখ হেক্টর জমিতে তেলবীজ ফসলের চাষ করে ১২.৩ লাখ মেট্রিক টন ফসল উৎপন্ন হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৯ থেকে ১০ শতাংশ। অর্থ্যাৎ দেশে ভোজ্যতেলের বাৎসারিক চাহিদার ৮০-৮৫ ভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানিকৃত সয়াবিন, পাম, ক্যানোলা ও সূর্যমুখী তেল দ্বারা এ চাহিদা পূরণ করা হয়। আমদানিনির্ভর ৯০ শতাংশই পাম ও সয়াবিন তেল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ৯২২ টন এবং একই সময়ে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত পাম তেল আমদানি হয়েছে যথাক্রমে ১২ হাজার টন ও ৯ লাখ ৬৪ হাজার টন। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে সয়াবিন, পাম, সরিষা ও রাইসব্রান তেল মিলিয়ে দেশে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার বেশির ভাগ অর্থাৎ ১৩ লাখ টনই পাম তেল এবং ৫ লাখ টন সয়াবিন তেল। বাকিটা সরিষা, রাইসব্রানসহ অন্যান্য তেল। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকার কারণে তেল আমদানি করা এমনিতেই জটিল। তার ওপর আরেকটি বড় সমস্যা হলো বেশি মুনাফার আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাম তেল মিশিয়ে বিক্রি করার প্রবণতা যা ভোক্তা সাধারণের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরিষার তেলের গুরুত্ব ও উপযোগিতা
সরিষার তেলের মনোআনসেচুরেটেড (গটঋঅ) এবং পলিআনসেচুরেটেড (চটঋঅ) ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকায় উক্ত তেল সেবনে রক্তে ঐউখ (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়তে থাকে এবং খউখ (খারাপ কোলেস্টেরল) এর পরিমাণ কমতে থাকে। এছাড়া রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরিষার তেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরিষার তেলে বিদ্যমান গ্লুকোসিনোলেট নামের মেটাবোলাইট বিশ্লেষিত হয়ে আইসোথায়োসায়ানেট তৈরি হয় যা ক্যান্সার কোষ গঠনে বাধা দেয়।
সরিষার তেলে ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড একটি আদর্শ অনুপাতে (১.২:১.০) থাকে এবং সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড অনেক কম থাকে বলে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আলফা-লিনোলেয়িক (অখঅ) নামক ওমেগা-৩ এবং ফ্যাটি অ্যাসিড ব্যথা বেদনা নিরাময়ে উপকারী। উল্লেখ্য, সয়াবিন তেলে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের অনুপাত অনেক বেশি (১১:১) এবং সয়াবিন তেলের স্মোক পয়েন্ট সরিষার তেলের তুলনায় ১৬০সে. কম। এ কারণে উচ্চ তাপমাত্রার তেলে ভেজে খাওয়ার জন্য সরিষার তেল বেশি উপযুক্ত।
সরিষার তেল গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ইরুসিক অ্যাসিড’ বিষয়ে বেশ মতভেদ রয়েছে। ১৯৭০ সালের দিকে ইঁদুরের শরীরে গবেষণার ফলাফল গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ঋউঅ মানব শরীরে গ্রহণের ক্ষেত্রে সরিষার তেল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে বিশদ গবেষণার পর ২০১৬ সালে ২% পর্যন্ত ইরুসিক এসিডকে গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রদান করা হয়। পক্ষান্তরে ইন্ডিয়ান লিপিড এসোসিয়ান তাদের গবেষণার প্রমাণ করে ও ঘোষণা করে যে, সরিষার তেলই হলো মানব শরীরের জন্য সবচেয়ে উপকারী তেল। তারা প্রমাণ করে যে, ইঁদুরের শরীরে ইরুসিক অ্যাসিড হতে ঊৎঁপুষ-ঈড়অ হওয়ার প্রক্রিয়াটি ত্রুটিযুক্ত এবং TG lipase I Erucic acid â-oxidation eûyme এর সক্রিয়তা কম থাকায় এটি Mayocardiac lipidosis তৈরি করে। কিন্তু মানব শরীরের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।
সম্প্রতি নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডারের বিরুদ্ধে ইরুসিক এসিডের উপকারী দিকসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও Multiple sclerosis I AI Zheimer's Disease এর বিরুদ্ধেও ইরুসিক এসিডের কার্যকরী ভূমিকা প্রমাণিত। তাছাড়া, ইরুসিক অ্যাসিড অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল হিসেবে, পেশিতে গ্লুকোজ গ্রহণের মাধ্যমে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সমস্যার সমাধানে, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে, কিছু ওষুধের বাহক উপাদান হিসাবেও ভূমিকা পালন করে।
করণীয়
আমাদের খাবারে ব্যবহার্য তেল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান দেশীয় ও বৈদেশিক বাজারের অবস্থাও বিবেচনা করতে হবে। তবে এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোনোভাবেই আমাদের নির্দিষ্ট কোনো একটি তেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। খাদ্যতালিকাতে সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, অলিভ অয়েল সবটাকেই স্থান দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের গবেষকগণের গবেষণাও আরও জোরদার করা প্রয়োজন। যেহেতু সরিষার তেলের ইরুসিক সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান, সেহেতু কম ইরুসিক অ্যাসিড সম্পন্ন সরিষার জাত উদ্ভাবন জরুরি।
এক্ষেত্রে ক্যানোলা জাত উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশীয় জার্মপ্লাজমের স্বল্পতা বিবেচনায় ক্যানোলা জাত উদ্ভাবনে মিউটেশন ব্রিডিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া প্রচলিত সরিষার জাত উন্নয়নে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির ব্যবহার করেও ইরুসিক এসিডের পরিমাণ কমানো সম্ভব। তাই সকল দিক বিবেচনা করে এটি বলা যায় যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক তেলের বাজার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দেশে তেলের বর্তমান উৎপাদন ইত্যাদিকে সামনে রেখে অদূর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সরিষার তেলকেই খাবার তেল হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কেননা, আমাদের দেশেই ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামীতে দেশের চাহিদার ৪০ শতাংশই পূরণ করা সম্ভব।
লেখক : মহাপরিচালক
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ