ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষাকে ধারণ করতে হবে হৃদয়ে

আজহার মাহমুদ

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলা ভাষাকে ধারণ করতে হবে হৃদয়ে

বাংলা ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা

বাংলা ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। তাজা রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের মুখের ভাষা। যে ভাষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না-জানা অনেকের জীবন,রক্ত ও ত্যাগ উৎসর্গ হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে যারা আমাদের বাংলা ভাষাকে মর্যাদাপূর্ণ করেছেন তাদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরপরও আমরা কেন জানি এই ভাষার সম্মান ও মর্যাদা পুরোপুরি ধরে রাখতে পারছি না। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বুকের রক্ত দিয়ে এ ভাষাকে যারা মহান করেছেন আজ আমরা যেন তাদের সেই প্রাপ্য সম্মানটুকুও দিতে পারছি না। নানাভাবে বাংলা ভাষাকে অপমান আর অপদস্থ করছি প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশের অনেকেই সাধারণত বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণে বলে থাকেন বা বলতে পছন্দ করেন। কথায় কথায় কয়েকটা ইংরেজি শব্দ বলে অনেকে নিজেকে বড় মনে করেন। অথচ তারা এটা বুঝতে পারেন না যে, এভাবে প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষাকে ছোট করা হচ্ছে। আমরা অনেকে ফেসবুকে এখন বাংলায় লিখি না। বাংলা বাক্যগুলোই লিখি ইংরেজিতে। মজা করে অনেকে এই ধরনের লেখার নাম দিয়েছেন বাংলিশ। ঘুরেফিরে এসব লেখায় অক্ষর থাকে ইংরেজি। আমরা আ, ই, ক, খ এখন প্রায় ভুলে গিয়েছি। ধ ন প ফ আমাদের কাছে এখন পরিচিত শব্দ।

এখনো অনেক লোক রয়েছেন যারা বাংলা ভাষায় কয়টি অক্ষর রয়েছে তাও জানেন না। জানলেও সব ঠিকমতো বলতে পারেন না। এমনও লোক পাওয়া যায় যারা বাংলায় যুক্ত বর্ণ লিখতে পারেন না। অথচ তারা ইংরেজিতে অনেক কঠিন শব্দ লিখে ফেলেন সহজেই। বাংলা বানান সম্পর্কে আমাদের ধারণা পর্যাপ্ত না থাকলেও ইংরেজি গ্রামার সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথেষ্ট। এটাই হচ্ছে আমাদের বাঙালিত্ব।

আসলে এমনই হয়ে পড়েছে আমাদের ভাষা। আমরা নিজেরাই এখন অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে, এই জন্যই কি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল? আসলেই আমরা বড় অদ্ভুত এক জাতি। আজ আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা ভুলে যেতে বসেছি।  
আমরা এখন আমাদের সংস্কৃতিটাও পরিবর্তন করে ফেলেছি। বাংলা ভাষার সংস্কৃতি, বাংলা সিনেমা, বাংলা নাটক, বাংলা গান, বাংলা গল্প, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস এমনকি বাংলা প্রবন্ধও আমাদের কাছে এখন বলতে গেলে বিরক্ত লাগে। আমরা ইংরেজি আর তামিল সিনেমা দেখি। আর একটু বেশি আধুনিক হলে হলিউড ছাড়া কিছুই দেখি না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের চাইতে আমাদের অনেকের কাছে শেক্সপীয়ারের বই বেশি গ্রহণযোগ্য। এমনটাই এখন বাংলার চিত্র। তাই বলে বলছি না তামিল সিনেমা না দেখতে, শেক্সপীয়ারের বই না পড়তে। কিন্তু বাংলাটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কেন? 
সত্যি বলতে এই অবস্থা আমাদের কারও একার কারণে নয়, গোটা সমাজ ব্যবস্থার কারণে। আমরা অন্য সংস্কৃতি আমার দেশে প্রবেশ করতে দিয়েছি। অথচ আমার দেশের সংস্কৃতি অন্য কোথাও প্রবেশ করাতে পারি না। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোয় দেশের চ্যানেল হাতে গুনে যা পাব তার দিগুণ পাব বিদেশী চ্যানেল। যার কারণে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন বিদেশী চ্যানেল এবং ওই ভাষাতেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। আমি আর কারও কথা বলব না।

আমার ঘরেই আমার ছোট ভাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আলাদিন এবং মোটো-পাতলু নামক দুটি অনুষ্ঠান দেখে। দুটোই হিন্দি ভাষার। তাকে যখন বাংলা মোটো-পাতলু বাংলাটা দেখতে বলি সে আগ্রহ দেখায় না। তার রুচি এখন হিন্দিতে চলে গেছে। আমরা যারা ’৯০-এর দশকে জন্ম নিয়েছি তখন বিদেশী চ্যানেল তো দূরের কথা, বিটিভি ছাড়া আর কিছুই দেখতাম না। বেশিরভাগ ঘরেই টিভি থাকলেও সেটা বিটিভিতে সীমাবদ্ধ থাকতো।

ছোটবেলায় শুক্রবার এলেই বসে থাকতাম বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। খেলতে যেতাম না। অথচ এখন আমার ছোট ভাইদের বাংলা সিনেমা তো দূরের কথা বাংলা চ্যানেলে যেতেও দেখা যায় না। এই যে বাংলার প্রতি অনীহা এবং অবহেলা এমন হতে থাকলে আগামী প্রজন্ম এই ভাষাকে নিয়ে গর্ব অহংকার করতে হয়ত ভুলে যাবে। 
এভাবে সব ক্ষেত্রে আমরা এখন বাংলাকে পেছনে রাখছি। আমরা বাইরে থেকে যতই বলাবলি করি, বাংলা দিয়ে ভালো কোনো চাকরি, সমাজের ভালো কোনো অবস্থানে যেতে পারি না। যাদের কথার মাঝে ইংরেজি থাকে নিয়মিত, যারা ইংরেজিতে দক্ষ তাদেরকেই সমাজ গ্রহণ করে ভালোভাবে। তাই সমস্যা আমাদের গোঁড়ায়। আর কিছু সমস্যা আমাদের মানসিকতার। আমাদের পারিবারিক শিক্ষারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সন্তানকে যে বিষয়ের ওপর উৎসাহী করবে সন্তান তো সেদিকেই যাবে। তবে দিন শেষে নিজের ভাষার প্রতি সম্মানটুকু যেন থাকে সেটাও আমাদের সকলের খেয়াল রাখা উচিত।
তাই আসুন, আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মান করি। আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মান করলে, এসব আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যবে। আমাদের প্রয়োজন বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে সবকিছু করা। বাংলার সঙ্গে যেন অন্য কোনো ভাষা মিশ্রিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। ভুলে গেলে চলবে না বাংলা আমাদের গর্ব, বাংলা আমাদের অহংকার। 

লেখক : সাংবাদিক

×