
শিল্প-সংস্কৃতি সুরক্ষায় করণীয়
বিশ্বজুড়ে নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চলমান প্রেক্ষাপটে প্রথম আমরা দেখি- বাঙালীর নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সব ধর্মের অনুসারীদের সুরক্ষা দিতে প্রণীত করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। ’৭২-এর সংবিধানে একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, অপরদিকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থাপন করে সব ধর্মের অনুসারীদের সমান অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে জনগণ উচ্চারণ করতে সক্ষম হলো- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।
ধর্মের কারণে কেউ বৈষম্যের মুখোমুখী হবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের পুরুষ-নারী আংশগ্রহণ করে প্রমাণ করেছিল- ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীস্টান- আমরা সবাই বাঙালী।’ ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার নেতৃত্বে জাতিকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দিতে এবং রাষ্ট্রকে পাকিস্তানী ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা যেমন মুছে ফেলা হলো, তেমনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনা হলো। বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলের একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুর দল, বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে।
তখন দেখা গেল- এই দীর্ঘ সময়ে সমাজ ধর্মের মূলনীতি- মানবতাবোধ, ভ্রাতৃত্ব বোধ ও সাম্যের বোধ হারিয়ে ফেলে হয়ে উঠেছে ধর্মীয় আচারনিষ্ঠ, অসহিষ্ণু, ধর্মান্ধ কিন্তু মহাদুর্নীতিবাজ, লোভী। এমন কট্টর আগ্রাসী সমাজে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সাংস্কৃতিক নানা ক্ষেত্রের শিল্প-সঙ্গীত, নৃত্য, ভাস্কর্য, যন্ত্রশিল্পী ইত্যাদি চর্চাকারী।
বঙ্গবন্ধু শুধু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছিলেন। এখন সেসব অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর একটি বড় সাফল্য ’৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের একটি গোষ্ঠীর যুদ্ধ-বিগ্রহ দ্বারা সৃষ্ট অশান্ত পরিস্থিতিকে সহিংসতা-মুক্ত করতে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা।
এর ফলে অস্ত্রধারীরা সরকারের ওপর আস্থা রেখে অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তির বার্তাবরণ তৈরিতে এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করে। পরবর্তীকালে, পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনীতির উন্নয়নে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন হয়। আধুনিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সুবিধা, উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষের আমলের জমি দখলে বাঙালী দখলদারদের হামলা, মামলার মুখে পড়ে নিরাপত্তাহীনতা ও অশান্তির মধ্যে পড়েছে দিনাজপুরে সাঁওতাল সম্প্রদায়, গাইবান্ধা, রাজশাহীতে সাঁওতাল ও গারো সম্প্রদায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা সম্প্রদায়।
হতদরিদ্র মানুষগুলো কৃষিকাজ, কলা, পান চাষ, জুম চাষ করে জীবন ধারণ করে। তারা তাদের মানবাধিকার সম্বন্ধে সচেতন নয়। বিত্তবান ও ক্ষমতাবান বাঙালীদের ওরা ভয় পায়। সুতরাং দেশের সুশীল সমাজের- সচেতন প্রগতিশীল গোষ্ঠীকে এসব অধিকার-বঞ্চিত, ‘মূঢ় মূক মুখে দিতে হবে ভাষা’ এবং নিশ্চিত করতে হবে তাদের জানমালের নিরাপত্তা, ভূ-সম্পদ ও জীবিকার অধিকার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভূমি ছাড়া আর কোন সম্পদ নেই। তারা না জানে ব্যাংক ব্যবস্থা, পায় না ঋণ।
রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা সেবার কম দামে চাল-আটা-তেল পাওয়ার কার্ড বা আশ্রয়ণ প্রকল্প- এসব কিছুর সুবিধা লাভের তালিকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম আছে কিনা, জানা নেই। তাদের ঘওউ-এর আওতায় আনা হয়েছে কিনা, তাও জানি না। এটা না করা হলে অতি অবশ্যই তাদের রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকারগুলো পৌঁছে দিতে হবে। ঘওউ কার্ড ছাড়া তো রাষ্ট্রীয় কোনরকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যায় না। তাই এটি তাদের প্রথম অধিকার।
এর বাইরে উদ্বেগজনক হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের গর্বের ও গৌরবের লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিমসহ শতাধিক সাঁইর অনুসারীদের ওপর মৌলবাদী নামে মানুষ নির্যাতক কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর বর্বর ও অসম্মানজনক হামলা, নির্যাতন। এ হামলা নির্যাতন মুসলিম সম্প্রদায়কে বিশ্বজুড়ে শিল্প-সংস্কৃতি-বিরোধী গোষ্ঠী ও ধর্মান্ধ হিসেবে উপস্থাপন করে চলেছে। এটি রাষ্ট্রের জন্যও বিব্রতকর ও মর্যাদাহানিকর।
জনগণ জানে, বঙ্গবন্ধু বাংলা সঙ্গীত, আব্বাসউদ্দীনের গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ভালবাসতেন। নিজেও গুন গুন করে গান গাইতেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গীত-বাদ্যযন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-ছায়ানটে ভর্তি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে গ্রামীণ সঙ্গীত শিল্পী লালনভক্তদের ২০০১- থেকে শুরু হওয়া দৈহিক নির্যাতন, তাদের জীবিকা ও বিনোদনের ওপর চরম অসম্মানজনক হামলা দেখে হতভম্ব হতেন, সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধু আজ নেই। তাই বলে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে লালন সাঁই এবং অবশ্যই অন্যান্য সাঁইর অসাধারণ মর্মস্পশী উদার, ধর্মীয়- শ্রেণী ভেদাভেদহীনতা প্রচারের উন্নত ভাব-আদর্শের গানগুলোর চর্চা করার কারণে তারা যে উগ্র, জঙ্গীবাদী কট্টর এবং মুক্তযুদ্ধের আদর্শবিরোধী গোষ্ঠীর তা-ব-নির্যাতনের শিকার হবে- তা জনগণ ও সুশীল-সংস্কৃতিবান-মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবাহী জনমানুষ কখনই মেনে নিতে পারে না।
এই লালনভক্ত উদার মানবতার গানকে যারা ধারণ করে দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন ধারণ করেন তাঁদের প্রাপ্য একটি বড় অভিনন্দন। তাঁদের স্থানীয় কট্টর, উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারের অনেক কিছু করণীয় আছে। যেমন-
-প্রথমত, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারী- বেসরকারী দলের নেতাকর্মীদের স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে ঐ কট্টর উগ্রবাদী অপরাধীদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
এই সুযোগে সরকার জানতে ও চিনতে পারবে, নির্দিষ্ট এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছে কোন কোন উগ্রবাদী। সরকার সহজেই এই নির্যাতক ব্যক্তিদের দল থেকে বহিষ্কার করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবে।
-প্রত্যেক জেলা, প্রত্যেক উপজেলা এবং প্রত্যেক গ্রামে লোকগান, লোকনাট্য, যন্ত্র শিল্পীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের স্থানীয় প্রশাসন থেকে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে ঐ এলাকার উগ্রবাদী ব্যক্তিদের তালিকা করে পুলিশের নজরদারিতে রাখতে হবে।
-সরকারের উচিত হবে- জেলা, উপজেলার মধ্যে লালনসহ ফকির-সাঁইদের গানের বার্ষিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করা। এটি নিয়মিত হলে, গায়করা সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হলে, সমাজে তারা ভাল অবস্থানে থাকবেন, সুরক্ষাও পাবেন। প্রতিযোগিতা বয়সভিত্তিক হতে হবে, যেমন- ৫০ উর্ধ, ২০-২৫, ১০-২০ বছর- এমন হতে পারে। জেলা, উপজেলা কর্মকর্তা, এস.পি, সংস্কৃতিকর্মীদের সাহায্যে কম ব্যয়ে এসব অনুষ্ঠান হতে পারে।
-সরকারী শিক্ষাক্রমে সঙ্গীত- বিশেষত লালন সঙ্গীত, অঙ্কন, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র, নাটক, আবৃত্তি- এসবের স্থান রাখার দাবি উঠেছে। এটিও একটি উপযোগী ব্যবস্থা হতে পারে। তবে, গায়ক, অঙ্কন শিল্পী, নৃত্যশিল্পী-শিক্ষক সম্ভবত কয়েক স্কুল মিলে একজনকে নিযুক্ত করা যেতে পারে, যারা সপ্তাহে এক একদিন এক এক স্কুলে শিক্ষা দেবেন। এ ব্যবস্থা সরকারী, বেসরকারী উভয় ধরনের স্কুলে থাকতে হবে। শীতের সময় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী যাত্রাপালা ও গ্রামীণ কৃষি ও শিল্পপণ্যের মেলার আয়োজন করা হলে উগ্রবাদ অনেকাংশে হ্রাস হতে পারে।
-সরকার পাকিস্তানী সরকারের অনুসরণে একটা কাজ করতে পারে। পাকিস্তানে ইচ্ছামতো যে কোন স্থানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় নিষেধাজ্ঞা আছে। কিছু জায়গায় মাদ্রাসা করাও নিষিদ্ধ। আমাদের দেশ ছোট। এখানে একটি উপজেলায় কয়টি মাদ্রাসা, কয়টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ থাকা উচিত- তার একটি জনসংখ্যাভিত্তিক, আধুনিক শিক্ষাসহ ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজনের নিরিখে নির্ধারণ করা খুব দরকার।
সমাজ-পাড়া-প্রতিবেশী সহানুভূতিশীল, উদার, মুক্তমনা না হলে, আমাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ’ কখনও অর্জিত হবে না। এই প্রকৃত বাংলাদেশ যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে অসহিষ্ণু অতি মুসলিম হবার প্রতিযোগিতা, যেখানে দুর্নীতি, দখল, লুটপাট, হত্যা স্বাভাবিকভাবে বেশি সংখ্যায় হচ্ছে। সমাজকে সহনশীল করে তুলতে সরকার ও সব শ্রেণী পেশার মানুষ, নতুন তরুণ প্রজন্মকে সক্রিয়, দৃঢ় পরিকল্পিত সুদৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ