
হিজরত অর্থ দেশত্যাগ। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর জন্মভূমি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে যান। পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রচারে জুলুম-নির্যাতন, দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও দেশত্যাগ নবীদের সুন্নাহ। দীন প্রচারের কারণে, মক্কার মুশরিকগণ তাঁর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সকল নির্যাতন প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নেয়। মসজিদে হারামে অবস্থিত দারুল-নাদওয়া তথা তদানীন্তন মক্কা পরিষদে মক্কার নেতাদের এক বৈঠক বসে। বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর আবু জাহেলের প্রস্তাব অনুযায়ী, মক্কার প্রতিটি গোত্রের একজন করে যুবক হাতে তলোয়ার নিয়ে মুহম্মদ (সা) কে রাতে হত্যা করার গোপন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর জিবরাইল (আ) ওহি নিয়ে আসেন এবং মুহম্মদ (সা)-কে বলেন, আল্লাহ আপনাকে হিজরতের আদেশ দিয়েছেন এবং এই রাতেই আপনাকে হিজরত করতে হবে। তিনি দুপুরে হজরত আবু বকরের ঘরে যান এবং তাকেসহ হিজরতের পরিকল্পনা নেন। এদিকে দুশমনরা ভোরে গৃহীত নৈশ অভিযানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দিনব্যাপী প্রস্তুতি নেয়। তারা মোট ১১ ব্যক্তি রাতের অন্ধকার নেমে আসার পর নবীর (সা) ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং মধ্যরাতের পর হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
আল্লাহ দুশমনদের চরম ধোঁকায় ফেলে দেন এবং তারা নিজেদের মিশনে ব্যর্থ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) হজরত আলীকে বলেন, আমার ইয়েমেনী চাদরটি পরে আমার বিছানায় শুয়ে থাক। দুশমন তোমার কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। তাঁর কাছে তিনি কুরাইশদের রাখা আমানত বুুঝিয়ে দেন এবং তাদের দিকে একমুঠি বালু নিক্ষেপ করে তাদের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি হজরত আবু বকরের (রা) ঘরে যান এবং তাকে নিয়ে মদিনার বিপরীত দিকে ইয়েমেনের পথে সাওর পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। কেননা, শত্রæরা তাঁর তালাশে বের হবে এবং তাঁকে মদিনার পথেই তালাশ করবে। সেদিন ছিল নবুয়তের চতুর্দশ সালের ২৭ সফর মোতাবেক ১২/১৩ সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। তাঁরা শুক্র, শনি ও রবিবার এই তিন দিন গুহায় থাকেন।
কুরাইশরা সর্বত্র তালাশ করে না পেয়ে জরুরী বৈঠকে মিলিত হয় এবং তাঁদের ২ জনকে ধরে দিতে পারলে ১শ’ উট পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে। ফলে এই বিরাট পুরস্কারের আশায় অশ্বারোহী, অনুসন্ধানকারী এবং পায়ের চিহ্ন বিশেষজ্ঞরা সকল মাঠ-ঘাট ও পাহাড়-পর্বতে পদব্রজ তল্লাশি শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা সাওর গুহায়ও এসে পৌঁছে। কিন্তু আল্লাহ তাঁদের হেফাজত করেন। আবু বকর (রা) পেরেশান হয়ে বলেন, তারা তো আমাদের দেখে ফেলল প্রায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) নিশ্চিন্তে বলেন, ‘পেরেশান হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন...।’
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহ দুটো বন্য কবুতরকে আদেশ করেছেন তারা যেন গর্তের প্রতিরক্ষার কাজ করে। সে অনুযায়ী কবুতর দুটো মাকড়সার জাল ও গাছের মাঝখানে বসে থেকে গুহার হেফাজত করে। আল কুরআনের এ আয়াতটি কতই না তাৎপর্যপূর্ণ : আল্লাহর জন্যই আসমান এবং যমিনের সৈন্যসামন্ত নিয়োজিত। কাফেরগণ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পেছনে পেছনে গুহা পর্যন্ত গেল। কিন্তু গুহার মুখে মাকড়সার জাল দেখে তারা সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেল। এভাবে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদ্বয়কে হেফাজত করেন।
সে সময় কাফেরদের তল্লাশির তীব্রতা কমে আসার পর রাসূলূল্লাহ (সা) আবু বকরকে সঙ্গে নিয়ে মদিনার পথে রওনা হন। তাঁরা পথপ্রদর্শক হিসেবে আব্দুল্লাহ বিন উরাইকাত আল-লিসীকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ করেন। অথচ সে মুশরিক ছিল। তাঁরা তাকে বিশ্বাস করে তার কাছে নিজের দুটো সওয়ারী হস্তান্তর করেন এবং তিন দিন পর সাওর গুহায় মিলিত হওয়ার জন্য চুক্তি করেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা) সফরের খাদ্যসামগ্রী তৈরি করেন কিন্তু তা সওয়ারীর সঙ্গে বেঁধে দিতে ভুলে যান। পরে তিনি নিজ কোমরের রশি দুই ভাগ করে এক ভাগ দিয়ে খাদ্যসামগ্রী বেঁধে দেন এবং অন্য অংশ নিজের কোমরে বাঁধেন।
উল্লেখ্য, এর আগে হজরত মুহম্মদ (সা) যখন মক্কা শরীফ থেকে সাওর পর্বত এলাকা ধরে মদিনার দিকে ছুটছিলেন, তখন সুরাকাহ ইবনে মালেক নিজ মুদলাজ গোত্রের এক আসরে ছিল। তাদের গোত্রের এক ব্যক্তি এসে তাকে বলল, আমি সমুদ্র উপকূলে মুহম্মদ ও তাঁর সাথীদেরকে দেখতে পেয়েছি। সুরাকাহ পুরস্কার লাভের সুযোগ ধরার উদ্দেশে তাকে বলল, ‘তুমি মুহম্মদকে নয় বরং অন্য কাউকে দেখেছ যারা আমাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে গেল।’ অথচ সে ঠিকমতোই বুঝেছে যে, তাঁরা ছিলেন মুহম্মদ (সা) ও তাঁর সহচরবৃন্দ। সে মজলিশে কিছুক্ষণ দেরি করে উঠে যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে। সে বলে, ‘আমি ঘরে গিয়ে আমার দাসীকে বলি যেন আমার ঘোড়াটি কিছুটা দূরে বের করে দিয়ে আসে। আমি ঘরের পেছন দিয়ে তীর নিয়ে ঘোড়ায় করে দ্রæত যাত্রা করি। আমি মুহম্মদ (সা)-এর কাছে পৌঁছার পর ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে মাটিতে বসে যায়। আমি নিচে নেমে তীর বের করি। তারপর লটারীর তীর নিক্ষেপ করে দেখি যে তাতে দুর্ভাগ্যের তীর ওঠে। তারপর আমি তীর ফেলে দিয়ে আবার ঘোড়ায় উঠি এবং রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে গিয়ে পৌঁছি। এমনকি আমি তাঁর কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনতে পাই। তিনি কোনদিকে ভ্রæক্ষেপ না করেই তিলাওয়াত করে চলছেন, কিন্তু আবু বকর (রা) চারদিকে লক্ষ্য রাখছেন। এবার আমার ঘোড়ার পা বালুতে ঢুকে পড়ে। আমি নেমে পড়ি এবং ঘোড়াটিকে পুুনরায় ওঠানোর চেষ্টা করি। ঘোড়াটি সামনের দুই পা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বালু ওড়ায় যা আকাশে ধোঁয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমি এবারও তীর দিয়ে লটারী চালাই এবং তাতে দুর্ভাগ্যের তীর উঠে। এই পরিস্থিতিতে সুরাকাহ রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে নিরাপত্তা কামনা করে। তিনি থামেন এবং নিরাপত্তা দেন। তারপর সে তার নিকট পুরো ঘটনা বর্ণনা করে। এবার সুরাকাহ নিজের পথের সম্বল তাঁদের খেদমতে পেশ করে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) তা নিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, আমাদের খবরটুকু গোপন রাখবে। সুরাকাহ তাকে লিখিত নিরাপত্তার অনুরোধ জানায়।
তিনি নবুওয়াতের ১৪ সালের ৮ই রবিউল আউয়াল, সোমবার কুবায় পৌঁছেন। সেদিনটি ছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর। মুসলমানগণ খবর পেয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। তাই তারা অধীর আগ্রহে প্রত্যেকদিন সকালে হারা নামক জায়গায় জড়ো হতেন এবং দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে ঘরে ফিরে যেতেন। তাদের প্রতীক্ষা দীর্ঘতর হতে থাকল। ঘরে ফিরে আসার সময় তারা একজন ইহুদীকে তাদের উঁচু কিল্লা থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) আগমন লক্ষ্য রাখার জন্য নিয়োজিত রাখতেন। যখন ইহুদী তাঁদের দেখলেন তখন চিৎকার করে জানালেন যে, তোমাদের রাসূল এসে গেছেন। তখন বনি আমর বিন আওফ গোত্রে তাকবীর ধ্বনী ও আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়। তারা ঘর থেকে বের হন এবং তাঁকে স্বাগত জানান। রাসূলুল্লাহ (সা) চুপ করে বসেন এবং আবু বকর (রা) দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকারীদের কুশলাদি বিনিময় করেন। যারা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ইতোপূর্বে দেখেননি, তারা আবু বকরকে নবী মনে করে তাকেই সাদর সম্ভাষণ জানাতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর গায়ে রোদ এসে পড়লে আবু বকর (রা) চাদর দিয়ে ছায়া দেন। তখন লোকেরা সবাই তাঁকে চিনতে পারেন।
গোটা মদিনায় তাঁকে স্বাগত জানানোর হিড়িক পড়ে যায়। মদিনায় এত বেশি আনন্দ-উল্লাস ইতোপূর্বে কখনও দেখা যায়নি। তিনি কুবায় বনি আমর বিন আওফ গোত্রের সরদার কুলসুম বিন হাদামের ঘরে ওঠেন। তিনি মদিনা পৌঁছার আগে কুবা পল্লীতে থাকা অবস্থায় মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন। মদিনা তাইয়্যেবায় তাঁর শুভাগমনের শুভ সূচনায় কুবা মসজিদ হজরতের শ্রম ও সংস্কারের প্রতীক হিসেবে আজও বিশ^ মুসলিমের পরম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়ে আছে। মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা) ইরশাদ করেছেন, কোন মুসলমান সফরে এসে নিজ আবাসস্থল থেকে অজু করে এ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলে একটি পরিপূর্ণ উমরাহর সাওয়াব পেয়ে থাকে। মূলত হিজরতের পর এবং কুবাতে পৌঁছার মধ্য দিয়েই মদিনার সোনালি ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। মদিনার আগের নাম ছিল ইয়াসরাব বা ইয়াসরিব। ইয়াসরিব অর্থ কাদাময় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চল। নবীজির আগমনের আগে মদিনাবাসীর মধ্যে পরস্পর অবিশ^াস ও হানাহানিতে এলাকাটি অনেকটা আবাসযোগ্যতাই হারিয়েছিল। মহানবী (সা) তাদের মধ্যে মুয়াখাত বা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জাগ্রত করেন। মদিনাবাসী তাদের চিরায়ত হানাহানি ভুলে গিয়ে মহানবীর (সা)-এর কাছে বায়াত হয়ে ইসলামের বিশ^ময় সৌন্দর্য বিকাশে সর্বত্যাগী ভ‚মিকা রেখে চিরকালের জন্য মিল্লাতে মুসলিমার শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্রে পরিণত হয়ে আছেন। তিনি মদিনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর শুধু কর্ম ও পরিবেশে নয়; ইয়াসরিব নামেরও পরিবর্তন আনেন। তিনি এ নাম মুখে নিতে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ, এ নাম হিংসাবিদ্বেষ ও হানাহানির প্রতীক। তাঁর হিজরতের বরকতে ইয়াসরিব পরিণত হয়েছে সোনার শহরে। সে থেকে মহানবীর (সা) পদধূলিতে ইয়াসরিব হলো মদিনা, মদিনাতুর রাসূল বা রাসূলের (সা) শহর।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]