
চলমান করোনা মহামারীতে দেশের মানুষ যেমন কষ্টে আছেন, তেমনই কষ্টে আছেন নিজস্ব বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন, ভাষা-সংস্কৃতি ছেড়ে যাওয়া আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার শ্রম অভিবাসনে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলেও বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা নানাভাবে সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছেন। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যারা দেশের বাইরে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয়, তাদের জীবনেও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মেঘ দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের করোনা-উত্তরকালের নতুন নিয়মকানুনের কারণেও প্রবাসীরা যেমন চাকরিচ্যুত হচ্ছেন, তেমনই হচ্ছেন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন।
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে থমকে থাকা শ্রমবাজারে এ বছরের শুরুর দিকে গতি ফিরে এলেও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের কয়েকটি দেশ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এ খারাপ সময়েও অর্থনীতিতে সুবাতাস ছড়িয়েছে প্রবাসী আয়। বিদায়ী অর্থবছরে দেশে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। যা আগের বছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। যদিও এ সময়েই করোনার কারণে কয়েক লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। অন্যদিকে যারা প্রবাসে আছেন, তাদেরও অনেকেরই আয় কমে গেছে। তারপরও বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ে অনেকটা জোয়ার ছিল। দেশে রফতানি আয়ের পাশাপাশি প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন নতুন উচ্চতায় উঠেছে। এমনকি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের প্রবাহের কারণেই সরকার এখন অন্য দেশকে ঋণ দেয়ার মতো সক্ষমতাও দেখিয়েছে। তদুপরি গ্রামীণ জনপদে থাকা প্রবাসীদের স্বজনরা করোনার আর্থিক প্রভাব থেকেও রেহাই পাচ্ছেন।
কিন্তু যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের অবদান যেমন থাকে সবচেয়ে বেশি, তেমনই যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিও হয় তাদেরই। এই অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের নিয়োগকারী ও প্রেরণকারী দুই দেশেরই অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও করোনা ভাইরাসের প্রভাবে তাদের নিয়োগকারী দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে চাকরি হারিয়ে প্রায় শূন্য হাতে দেশে ফেরা শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টা সত্তে¡¡ও অভিবাসন প্রক্রিয়াকে এখনও নিরাপদ করা যায়নি। এখনও অবসান হয়নি তাদের হয়রানি দুর্ভোগ ও বঞ্চনার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ৯টি মূল সনদের একটি হলো- ‘অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ।’ সনদটি ১৯৯০ সালে গৃহীত হয় এবং ২০০৩ সালে কার্যকর হয়। অবাক করা বিষয় হলো, এ সনদের পক্ষভুক্ত ৫৫টি রাষ্ট্রের প্রায় সবটিই অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী রাষ্ট্র। অর্থাৎ অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী বা নিয়োগকারী কোন রাষ্ট্রই এ সনদে পক্ষভুক্ত হয়নি। যে কারণে সনদে বর্ণিত কোন দায়-দায়িত্ব পালনেও তাদের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায়নি। বাংলাদেশ মূলত অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ। সনদের পক্ষভুক্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার দায়-দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হলেও শ্রমিক গ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করার ফলে এই শ্রমিকদের অধিকারের পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরেকটি মূল সমস্যা হচ্ছে অশিক্ষা ও অদক্ষতা। বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিকই এখনও তার ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার সম্পর্কে জানেন না। চাকরিস্থল বা কাজের ধরন সম্পর্কে প্রকৃত তথ্যও জানতে পারেন না অনেকে। এমনও হয় যে, তাদের অনেকে অনেক ক্ষেত্রে চুক্তির কাগজটিও হাতে পান না। এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে অনেকেই পড়েন চরম বিপদে। কিন্তু প্রয়োজন তো বিধিনিষেধ মানে না। তাই ছুটছে মানুষ। জায়গা-জমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে, এমনকি ধারকর্জ করেও বিদেশে যাওয়ার জন্য দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, প্রতারণার শিকার ৫১ শতাংশের মধ্যে ১৯ শতাংশ মানুষ টাকা দেয়ার পরও বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাকি ৩২ শতাংশ প্রতারণার শিকার হয়েছেন বিদেশে যাওয়ার পর।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য মতে, গত বছরের এপ্রিল থেকে বিগত এক বছরে চাকরি হারানোসহ নানা কারণে দেশে ফিরেছেন প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী শ্রমিক। বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশফেরত এসব শ্রমিকের ৫৩ শতাংশই দিনমজুরিসহ ছোট কোন কাজে যুক্ত হয়ে জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করছেন। বাকি ৪৭ শতাংশের আয়ের কোন পথ নেই।
সঙ্কটময় এই সময়ে প্রবাসীদের পাশে রাষ্ট্রসহ সবার থাকাটা জরুরী। কারণ, যারা ফিরে এসেছেন তাদের আর্থিক ক্ষতির কোন শেষ নেই। এদের অনেকেই কম পক্ষে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লোন নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই টাকা শোধ না হতেই ফিরে আসতে হয়েছে। অনেকেই আবার ফ্রি ভিসায় গিয়েছিলেন। ফলে, তাদের কোন নিয়োগকর্তাও নেই।
কাজ হারিয়ে ফেরা বিশাল এই প্রবাসী জনবলের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান তৈরি করাও নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন কাজ। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরও কয়েকটি সংস্থার সহায়তায় ব্র্যাকের উদ্যোগে বিদেশফেরত ৭ হাজার ২৫০ কর্মীকে নগদ অর্থ দেয়া হয়েছিল। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সরকারও ২০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। ৪ শতাংশ সুদে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ওই ঋণের অর্থ বিতরণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কাগজপত্র-সংক্রান্ত জটিলতা ও নানা শর্তের বেড়াজালে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তবে এবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এককালীন আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি অন্য সমর্থনমূলক উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একনেক সভায় বলেছেন, প্রবাসীরা এতদিন অর্থ পাঠিয়ে দেশকে অনেক দিয়েছেন, এবার তাদের দেবে দেশ। তাদের প্রয়োজনে সম্ভব সবই করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ জন্য একটি প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ ছাড়াও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হবে।
বলা হয়েছে, অনুমোদিত প্রকল্পটি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। প্রাথমিকভাবে প্রবাসী অধ্যুষিত হিসেবে বিবেচিত জেলাগুলোর প্রবাসীরা এতে প্রাধান্য পেলেও ধাপে ধাপে অন্যান্য জেলার প্রবাসীদেরও এর আওতায় আনা হবে। এর আগে বিভিন্ন সহায়তার ক্ষেত্রে তালিকা প্রস্তুতিতে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তও অনেকে সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। জনপ্রতনিধিদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ আত্মীয়স্বজন কিংবা তাদের অনুগত লোকজনদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করেছেন এমন খবরও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। প্রবাসী সুফলভোগীদের তালিকা তৈরিতে এবার যাতে সে রকম কিছু না হয়, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। সঠিকভাবে তালিকাটি প্রস্তুত করা গেলে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হবে না।
মনে রাখতে হবে, মানুষ খুব একটা দায়ে না পড়লে নিজস্ব বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন, ভাষা-সংস্কৃতি ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমায় না। যারা যায়, তারা নিতান্ত দায়ে পড়েই যায়। কিন্তু অভিবাসী কর্মজীবীদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। ঘাম ও অশ্রæ মেশানো রেমিটেন্স সরবরাহ করে দেশের অর্থনীতিতে শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড় করাতে বছরের পর বছর ধরে তারা ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপে তাদের অনেকেই আজ তীব্র আর্থিক ও মানবিক সঙ্কটে।
করোনাকালে মানবিক সঙ্কটে ভোগা এই অভিবাসী শ্রমিকদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যেটা উপলব্ধি করেছেন, সেটা অনেকেরই মনের কথা। সরকার তাদের জন্য নানা উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। কিছু দিন আগে সৌদি আরবসহ অনেক দেশে টিকা না নেয়া শ্রমিকদের ৭ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হলে, সরকারের তরফ থেকে কোয়ারেন্টাইনে থাকার খরচের অর্ধেক বা জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণা আসে। সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। বিমানবন্দরে করোনা টেস্টের জন্য পিসিআর ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে অনেকই করছে সরকার। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে আর সবটা করা সম্ভব নয়। বেসরকারী উদ্যোগকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। তারা দেশকে অনেক দিয়েছেন। এখন এদের জীবনকে নিরাপদ ও স্বস্তিকর করে তুলতে সবারই এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক [email protected]