
পৃথিবীর সব ধর্মেই অতিথি বা মেহমানের সমাদর, যত্ন ও আপ্যায়ন করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আতিথেয়তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হাজার হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় অতিথির প্রয়োজন পূরণ এবং তাকে সেবাদান করা ঐশ্বরিক বিধান হিসেবে পালিত হতো। মুসলমানদের ধর্মপিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) মেহমান ব্যতীত কখনও খাবার গ্রহণ করতেন না। মেহমান না থাকলে তিনি কোন দরিদ্র মানুষকে নিয়ে আসতেন এবং তাকে আপ্যায়ন করাতেন। কথিত আছে, একদিন নবী ইব্রাহীম পেটে ক্ষুধা নিয়ে কোন মেহমানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়। ডাকার মতো কোন লোক পেলেন না। হঠাৎ এক বৃদ্ধ লোকের দেখা। তাকে অনুরোধ করলেন তাঁর সঙ্গে খাবার গ্রহণের। নবী ইব্রাহীম ও বৃদ্ধ লোকটি খেতে বসলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইব্রাহীম বললেন, নিন, বিসমিল্লাহ করুন। দেখা গেল লোকটি বিসমিল্লাহ না বলেই খাবার মুখে দিলেন। খাবার শুরুতে আল্লাহর নাম না নেয়ায় ইব্রাহীম নবী মনোক্ষুণ্ণ হলেন। আগন্তুকের কাছে জানতে চাইলেন কেন খোদার নাম নিলেন না। মেহমান বললেন, হুজুর আমি অগ্নি উপাসক। খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম নেই না। ইব্রাহীম তার এই উত্তরে আরও রাগান্বিত হলেন। কারণ খোদার পৃথিবীতে খোদার প্রতি বৃদ্ধের এই অবাধ্যতা। তিনি তাকে দস্তরখান বা খাওয়ার বৈঠক থেকে উঠিয়ে দিলেন। বললেন, খোদার নাফরমানকে আমি খাওয়াই না। অগত্যা লোকটি হাঁটা দিল। এদিকে মহান আল্লাহ পাক আসমান থেকে ইব্রাহীমের কাছে সহিফা বা বাণী পাঠালেন। বললেন, ইব্রাহীম! যাকে আমি পৃথিবীতে খাবার দিয়ে ৬০/৭০ বছরে উন্নীত করেছি তুমি তাকে একবেলা খাওয়াতে গিয়ে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করলে কেন? ইব্রাহীম তার আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বৃদ্ধকে আবার খুঁজে এনে খাবার দস্তরখানে বসালেন।
প্রাচীন ভারতে অতিথিকে দেবতা জ্ঞান করা হতো এবং বর্তমানেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতিথি ব্যক্তি দেবতা হিসেবে বিবেচিত হন। এস্কিমো জাতিগুলোর মধ্যে অতিথিসেবার জন্য অদ্ভুত নানা প্রথা প্রচলিত আছে। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসাফির ও আগন্তুককে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আরবদের আতিথেয়তার কথা বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে অমর কীর্তি হয়ে আছে। এখন আমরা কথায় কথায় বলি তুমি এত দানশীল হয়েছ কবে থেকে? হাতেম তাই হয়েছ নাকি? উল্লেখ্য, আরব ইতিহাসে দান ও মেহমানদারীতে হাতেম তাই একজন বিখ্যাত প্রবাদ পুরুষ। একটি বিশেষ যুগের আরববাসীর জঘন্য জীবনাচরণের সময়কে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু তখনও তাদের আতিথেয়তা ছিল অপূর্ব ও অদ্ভুত। কখনও প্রাণের শত্রæও সন্ধ্যায় অতিথি হয়ে ঘরে ঢুকলে সারারাত তাকে নিরাপদ আশ্রয় দান করতো এবং বলতো সূর্য ওঠার আগেই আপনি আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবেন। কারণ, নানা কারণে আমরা দু’জন বা দু’পক্ষ শত্রæভাবাপন্ন। কাল সকালে হয়তো আমার প্রতিশোধের স্পৃহা জ্বলে উঠতে পারে।
ইসলামে আতিথেয়তার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি এবং বলা যায় তা আবশ্যক। এটি সর্বোত্তম চরিত্রের বহির্প্রকাশ এবং সব নবীর সুন্নত বা সুন্নাতুল আম্বিয়া। পবিত্র কুরআনে অতিথির সম্মান ও সেবা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, ‘তারা আমার মেহমান, তাদের অসম্মান করোনা’ (সুরা হিজর : ৬৮)। ‘তারা বলল, সালাম, তিনিও বললেন, সালাম। তিনি অবিলম্বে এক কাবাবকৃত গো-বৎস পরিবেশন করলেন’ (সুরা হুদ : ৬৯)।
রাসুল (সা.)-এর অতিথিপরায়ণতা সর্বজনবিদিত। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘কেউ যদি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে থাকে সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে’ (বোখারী : ৬০১৮)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, মেহমানের পুরস্কার একদিন ও একরাত। অতিথি-আপ্যায়ন হলো তিন দিন; এর বেশি হলে তা হবে সদকা’ (মুসলিম : ৪৬১০)। বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ঈদ-উৎসব, বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে অতিথি আপ্যায়নের রীতি রয়েছে। সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও পুরান ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে অতিথি আপ্যায়নের গৌরবময় ঐতিহ্য। বিশেষত, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানির গোশত ইতিহাস বিখ্যাত।
সনাতন (হিন্দু) ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদে উল্লেখ আছে যে, অতিথি দেবতুল্য। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অতিথিকে দেবতা মনে করেন এবং তাকে যথার্থ সম্মান করেন। অতিথি ও আগন্তুককে আপ্যায়ন করা এবং রাতযাপনের ব্যবস্থা করা হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সন্যাসী, ব্রাহ্মণ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে অতিথিসেবা প্রদান করা প্রায় আবশ্যক বিষয়। গৃহকর্তা ধনী হোক আর দরিদ্র হোক, অতিথির জন্য তিনটি জিনিসের ব্যবস্থা করতে হবে, খাবার (এমনকি এক গøাস পানি হলেও), বসার জায়গা এবং সুন্দরভাবে কথা বলা।
বাইবেলের শিক্ষা অনুসারে আগন্তুক ও মুসাফিরকে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করা খ্রীস্টানদের অতিথেয়তার প্রধান অনুষঙ্গ। পিটার রচিত বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রত্যেকে একে অপরকে ভালবাসব, কারণ আমরা ভালবাসার ওপর টিকে আছি। ভালবাসার অর্থ হলো অন্নহীনকে অন্নদান এবং গৃহহীনকে গৃহদান।’ (পিটার, ৪: ৮)।
সাধারণ অতিথিদের কেবল আপ্যায়ন করিয়ে সন্তুষ্ট করলে হবে না; বরং তাদের সঙ্গ ও সময়ও দিতে হবে। জনৈক ইহুদী ধর্মগুরুর জারিকৃত বিধান হলো- ‘কোন ইহুদী যেন এ কথা বলতে না পারে আমি জেরুজালেমে রাতযাপনের জায়গা পাইনি।’ ইহুদীদের অতিথিপরায়ণতা অবশ্য নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আসলে মেহমানদারী করা ও মেহমান হওয়া দুটোই অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক দিক। এ বৈশিষ্ট্য ছাড়া সমাজ সুন্দর ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি করা কোনমতেই সম্ভব নয়। নবী (সা.) বলেছেন, তাহাদ্দু তাহাব্বু- তোমরা পরস্পর হাদিয়া বিনিময় কর, এ দ্বারা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি কর।’ মেহমানদারী ও মেহমান হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু নিয়ম রক্ষা করা উচিত। যেমন, কারও মেহমান হতে হলে আগে তাকে জানানো যেন মেজবান বিব্রত না হয়। মেহমান ও মেজবান উভয়ের মধ্যে সালাম প্রথারও ব্যবহার থাকা উচিত। সালাম প্রদান এক ধরনের অনুমতির মতো। পবিত্র কুরআনে কারও বাসায় ঢুকার আগে সালাম প্রদানের মাধ্যমে অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। আমাদের অনেকে অসময়ে মেহমান হয়ে মেজবানের বিরক্তি ঘটান অথবা দাওয়াতের সংখ্যার বেশি আগমন করে মেজবানকে বিব্রত করেন। তা কখনও উচিত নয়।
একইভাবে মেহমানের উচিত সাহেবে দাওয়াত বা মেজবানের দেয়া বা আয়োজিত বসার স্থানে সন্তুষ্ট চিত্তে বসা। যদি সম্ভব হয় উভয়ের সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য তার ঘরের কোন আয়োজনের প্রশংসা করা। আমরা অনেক সময় সরাসরি বলে ফেলি ভাত ভাল মতো সেদ্ধ হয়নি। তরকারিতে যদি আরেকটু লবণ হতো, ভাল হতো। এ ধরনের চটজলদি বলার অভ্যাসটি খুবই খারাপ। এর দ্বারা মেজবানের সঙ্গে মেহমানের যেমন হঠাৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয় তেমনি মেজবানের সঙ্গে তার স্ত্রী পরিজনের সঙ্গেও মনোমালিন্যের সম্ভাবনা থাকে। আমাদের নবী (সা.) যার ওপর লাখো দরূদ ও সালাম, তিনি কারও বাসার কোন খাদ্য অপছন্দ হলে কম গ্রহণ করতেন। কিন্তু কোন কমেন্ট করতেন না। বরং এর মধ্যে ভাল গুণগুলো বেছে নিয়ে প্রশংসা করতেন। মনে রাখতে হবে, মেহমান শুধু খাবারেই সন্তুষ্ট হয় না, তাকে কথাবার্তা দিয়ে গল্প আড্ডা দিয়েও সন্তুষ্ট করতে হয়। কখনও কোন মেহমানকে সন্তুষ্ট করার জন্য নফল রোজাদারকে অতিথিপরায়ণের জন্য রোজা ভেঙ্গে তার সঙ্গে পানাহারের জন্য ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আসুন, আমরা অপচয় থেকে দূরে থাকি, লোক দেখানো মানসিকতা পরিত্যাগ করি। মেহমানকে মর্যাদা দান সওয়াবের অংশ মনে করি এবং মেহমানরাও যেন অন্যের দুঃখ কষ্ট বুঝে আদব রক্ষা করে চলি।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]