বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের ঐতিহাসিক রায়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর প্রায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে এ খাতে তেমন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই যে, বঙ্গোপসাগর একটি সুবিশাল মাছ ও জলজ প্রাণীর ভান্ডার। প্রায় পাঁচ শ’ প্রজাতির সুস্বাদু মাছ রয়েছে এখানে, যার অধিকাংশই অনারোহিত। তদুপরি সমুদ্র তলদেশ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদের অফুরান ভান্ডার। ভারত ও মিয়ানমার এ দুটো ক্ষেত্রে সমুদ্র সম্পদ আহরণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে অনেকাংশে। জরিপ ও গবেষণার কাজটিও প্রায় স্থবির, গতিহীন। দক্ষ জনবলের অভাবও প্রকট, তদুপরি ১৯৭৪ সালের মেরিটাইম জোনস আইনটিও সংস্কার ও সংশোধন করা হয়নি অদ্যাবধি।
২০১৭ সালে দেশের সুবিস্তৃত ও অমিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ সমুদ্র সম্পদের অনুসন্ধানে উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৪০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল, যাদের মধ্যে আছেন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ; বিশেষ একটি জরিপ জাহাজে প্রাথমিক অনুসন্ধানে গিয়েছিল বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে। সেখানে অবস্থানরত মৎস্য সম্পদসহ বিভিন্ন সম্পদের নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে নেয়ার কথা ছিল পরবর্তী পদক্ষেপ। ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদী প্রকল্পের আওতায় একটি জরিপ জাহাজও কেনা হয়েছিল। যদিও সেটির আধুনিকায়নসহ অনেক কাজ ছিল বাকি। এই কাজের অগ্রগতি পরে আর জানা যায়নি।
বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত। সীমিত পর্যায়ে কিছু পরিমাণ তেল-গ্যাস এবং মৎস্য সম্পদ আহরণ করা হলেও, তার পরিমাণ বঙ্গোপসাগরের অফুরন্ত সম্পদের তুলনায় খুবই নগণ্য। এমনকি সমুদ্র সম্পদ সম্পর্কে জরিপ চালানোর উপযোগী আধুনিক জাহাজ পর্যন্ত নেই। সময়ে সময়ে বাপেক্সসহ বিদেশী সহায়তায় যৎসামান্য জরিপ কার্জ চালানো হলেও বঙ্গোপসাগরের অমিত ও অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা জানি খুব কম। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ভারত এবং ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকায় (টেরিটোরিয়াল সি) অধিকার লাভে সফল হয়। ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অন্যান্য সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। অথচ এই বিশাল অঞ্চলে কী পরিমাণ মৎস্য ও খনিজ সম্পদ রয়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। ব্লু ইকোনমি বা নীল সমুদ্রের অর্থনীতি হিসেবে খ্যাত এই অঞ্চলের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৯টি মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্লু ইকোনমি সেল। গভীর সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বহুমুখী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর আওতায় ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হবে অত্যাধুনিক মাল্টিডিসিপ্লিনারি জাহাজ। বাকি ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে অবকাঠামো উন্নয়নসহ গবেষণার কাজে। জরিপ জাহাজটির মাধ্যমে সুবিস্তৃত ও সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের বুকে ও তলদেশে যাবতীয় মৎস্য জলজ সম্পদ ও তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং এসবের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা জানা সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে অতি মূল্যবান ইউরেনিয়াম, প্লাটিনাম, থোরিয়ামসহ দুর্মূল্য ও দুর্লভ নানা খনিজ পদার্থ পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অগভীর সমুদ্রে রয়েছে বিপুল পরিমাণ ঘন কাদা, যা হতে পারে সিমেন্ট তৈরির অন্যতম উপাদান। প্রাপ্তিসাপেক্ষে এসব মূল্যবান খনিজ উত্তোলন ও আহরণ সম্ভব হলে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।