ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ

বিমা আইনে আসছে বড় পরিবর্তন, থাকছে না পরিবারতন্ত্র

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ২৩ জুন ২০২৫

বিমা আইনে আসছে বড় পরিবর্তন, থাকছে না পরিবারতন্ত্র

বিমা আইনে আসছে বড় পরিবর্তন

বিমা খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারিতে বিমা আইন ২০১০-এ বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে পরিবারতন্ত্র রোধ করে দুর্নীতি রোধ এবং বিমা গ্রাহক বা পলিসিধারীদের স্বার্থ রক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আরও যে সকল সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে, পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগে কঠোর বিধান, পরিবারের মালিকানায় সীমা, এবং দেউলিয়া বা ব্যর্থ বিমা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব সংশোধনীর মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি করা হলে দেশের বিমা খাতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে।  
জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতোমধ্যেই তাদের ওয়েবসাইটে অধ্যাদেশটি সংশোধনের খসড়া প্রকাশ করেছে এবং জনমত আহ্বান করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত করা হবে এই অধ্যাদেশ।
২০১০ সালে প্রণীত বিদ্যমান বিমা আইনে গুরুতর কিছু ঘাটতি রয়েছে যেমন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অপসারণ, বা প্রতারণা ও দেউলিয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে রিসিভার নিয়োগের কোনো বিধান নেই। একই পরিবারের কতজন বিমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন, কিংবা কতদিন সেই দায়িত্বে থাকতে পারবেন-এ সম্পর্কেও কোনো সীমা নেই।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ৮২টি বিমা কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বিমা এবং ৪৬টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানি। তবে গ্রাহকের প্রিমিয়াম সরাসরি গ্রহণকারী জীবন বিমা কোম্পানিগুলো প্রতারণা ও দুর্নীতির জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে একাধিক কোম্পানি গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ তথাকথিত বিনিয়োগের নামে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এর ফলে ফারইস্ট ইসলামি লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, সানলাইফ, বায়রা লাইফ, পদ্মা ইসলামি লাইফ এবং সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স- এই ছয়টি কোম্পানি গ্রাহকদের ৩,৭৩৬ কোটি টাকার দাবি পরিশোধে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কোম্পানির কিছু পরিচালক হয় আত্মগোপন করেছেন, অথবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ বা ইডরা) চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, “এই কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা বিনিয়োগের নামে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কোম্পানিগুলো এখন অনেকটা দেউলিয়া হওয়ার পথে। আমরা আইন সংশোধন করছি যাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।”
খসড়া অধ্যাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- বিমা কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহককে অর্থ ফেরত দিতে রিসিভার নিয়োগের বিধান। ২০১০ সালের আইনে এই ক্ষমতা ছিল না।
এছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম অপসারণের এখতিয়ার দেওয়া হচ্ছে, যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইনের অধীনে এই ধরনের ক্ষমতা ইতোমধ্যেই বিদ্যমান।
দেশের বিমা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পরিবারভিত্তিক দখলদারিত্ব ও পরিচালনা বন্ধে খসড়া অধ্যাদেশে আনা হচ্ছে বড় পরিবর্তন। এর আওতায় কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা কোনো পরিবার মিলে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার রাখতে পারবে না। পরিবার বলতে খসড়া অধ্যাদেশে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন এবং জামাতা ও পুত্রবধূকে বোঝানো হয়েছে। গোপনে কেউ ১০ শতাংশের বাড়তি শেয়ার ধারণ করলে, কর্তৃপক্ষ তার শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে অন্যদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। এক্ষেত্রে শেয়ারের ফেস ভ্যালু বা বাজারমূল্যের মধ্যে যেটি কম হয় সেই দামে শেয়ারগুলো বিক্রি করবে ইডরা।
এ অধ্যাদেশে পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কমাতে একই পরিবারের সর্বোচ্চ দুইজন পরিচালক নিয়োগের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোম্পানির নিজস্ব গঠনতন্ত্র যা-ই বলুক, এ নিয়ম অমান্য করা যাবে না। পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ সকল পরিচালক নিয়োগে ইডরার আবশ্যিক অনুমোদন নিতে হবে।
নতুন খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে,  একই ব্যক্তি একই শ্রেণির সর্বোচ্চ একটি বিমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন। পাশাপাশি, কোনো প্রতিষ্ঠান একাধিক পরিচালক নিয়োগ দিতে পারবে না, কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রক্সি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। বিদ্যমান আইনে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই, যার ফলে সুবিধাভোগীদের একচ্ছত্র দখল গড়ে উঠেছে।
পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে খসড়া অধ্যাদেশে আরও কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এসব ধারায় বলা হয়েছে, বিমা কোম্পানির পরিচালক হতে হলে কমপক্ষে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোনো ঋণ খেলাপি, ফৌজদারি অপরাধে দ-িত হলে বা জালজালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোনো অবৈধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকলে তিনি পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন কোনো কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল হলে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হলে তিনিও কোনো বিমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারবেন না।
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বিমা কোম্পানিগুলোর সংঘবিধিতে যাই থাকুক না কেন, একটি বিমা কোম্পানিতে সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক থাকতে পারবে। আর এই ২০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬ জন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে হবে।
কোনো বিমা কোম্পানিতে পরিচালকের সংখ্যা ২০ জনের কম হলে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা মোট পরিচালক সংখ্যার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ হতে হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত তালিকাভুক্ত পরিচালকদের মধ্য হতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। বিদ্যমান আইনে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই।
আইনের সংশোধনীতে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (ইডরা) নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা বড় পরিসরে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশটি পাস হলে বিমা কোম্পানির অর্থায়নে গঠিত সাবসিডিয়ারি কোম্পানি, ফাউন্ডেশন বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারির ক্ষমতা পাবে। পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থের পরিপন্থি মনে করলে কর্তৃপক্ষ ওই কোম্পানির নতুন প্রিমিয়াম গ্রহণ নিষিদ্ধ করতে পারবে এবং পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় কর্তৃপক্ষ যে কোনো আদেশ দিতে পারবে।
খসড়া অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, কোনো বিমা কোম্পানি তার সম্পদ বা বিনিয়োগ বন্ধক বা জামানত রেখে, কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার বা তাদের পরিবারের ব্যক্তিদের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো উৎস হতে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে না এবং অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা দিতে পারবে না।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই পরিবর্তনগুলো মূলত কোম্পানির সম্পদ অপব্যবহার রোধ এবং শক্তিশালী তদারকি নিশ্চিত করতেই আনা হয়েছে।
অধ্যাদেশটি পাস হলে বিমা কোম্পানির অর্থায়নে গঠিত সাবসিডিয়ারি কোম্পানি, ফাউন্ডেশন বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
গ্রাহকদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে তহবিল গঠন ॥ খসড়া অধ্যাদেশে লাইফ ও নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলোর পলিসি গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ প্রাপ্যতা পূরণের জন্য পৃথক তহবিলে আলাদাভাবে অর্থ সংরক্ষণ করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, লাইফ ও নন-লাইফ কোম্পানিগুলো প্রতিবছর প্রাপ্ত গ্রস প্রিমিয়াম হতে অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাদ দিয়ে বাকি অর্থ এই তহবিলে জমা করবে।
এই তহবিলের অর্থ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিরাপদ ও লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত আয়ও এই তহবিলে জমা হবে।
বিমা কোম্পানিগুলোর এজেন্টদের পারিশ্রমিক পুনঃনির্ধারণ করার কথাও বলা হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে। বর্তমানে কোনো বিমা কোম্পানির এজেন্ট তার পারিশ্রমিক বাবদ প্রথম বছর পলিসি গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া প্রিমিয়ামের ৩৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর নবায়ন প্রিমিয়ামের ১০ শতাংশ এবং পরবর্তী বছরগুলোতে নবায়ন প্রিমিয়ামের ৫ শতাংশ পেয়ে থাকে।
প্রথম বছরের জন্য এটি সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরের জন্য নবায়ন প্রিমিয়ামের ১৫ শতাংশ এবং পরবর্তী বছরগুলোর জন্য নবায়ণ প্রিমিয়ামের ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের বিমা খাত মোট ১৮ হাজার ২২৭ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করেছে, যেখানে মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ বাংলাদেশি কোনো না কোনো বিমা কভারেজের আওতায় রয়েছেন। ওই বছর জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মোট দাবি এসেছে ১২,০৫১ কোটি টাকা। তবে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৮,৭২৮ কোটি টাকা। নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলো পেয়েছে ৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকার দাবি, যার মধ্যে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা।

×