ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

ইরানের তিন পরমাণু কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২৩ জুন ২০২৫

ইরানের তিন পরমাণু কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

ইরানের ফোর্দো পরমাণু স্থাপনা লক্ষ্য করে বাঙ্কার বাস্টার বোমা নিক্ষেপ করা হয়

ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পরমাণু স্থাপনায় রাতের আঁধারে যুক্তরাষ্ট্র এসব হামলা চালায়। শনিবার স্থানীয় সময় রাত ২টা ১০ মিনিটে প্রথম বোমা ফেলে ফোর্দোতে। এই হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে অত্যাধুনিক বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে একটানা প্রায় ৩৭ ঘণ্টা উড়ে ইরানের তিন পরামাণু স্থাপনায় এ হামলা চালানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন জানিয়েছেন, ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে পরিচালিত এই অভিযানে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বি-২ বোমারু বিমান স্থানীয় সময় শুক্রবার উড্ডয়ন করে এবং নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে হামলা চালায় বিশেষ এই বিমান।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কেইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর একাধিক শাখা পরিকল্পিতভাবে ও সমন্বিতভাবে এই অভিযান পরিচালনা করে।
এদিকে ইরানে হামলা চালানোর সময় সে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিরোধ আসেনি বলে উল্লেখ করেন জেনারেল কেইন। তিনি বলেন, ‘ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে কোনো গুলি ছোড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ইরানের কোনো যুদ্ধবিমান আকাশে ওড়েনি, মনে হচ্ছে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শনাক্তই করতে পারেনি।’
হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরানের মূল পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ করা হয়েছে। ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলার পর রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এই মন্তব্য করেন। ট্রাম্প বলেন, ইরানকে এখন শান্তির পথে আসতেই হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের হামলা হবে।
এদিকে মার্কিন হামলার পর ইরান এর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। ইরানি রাষ্ট্রীয় টিভিতে বলা হয়েছে, এখন বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিটি মার্কিন নাগরিক ও সেনা ইরানের হামলার বৈধ লক্ষ্য।
কয়েকদিন আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-ইরান সংঘাতে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তারা এমন ক্ষতির মুখে পড়বে যা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হবে না।’
আর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাগচি যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলাকে ‘গর্হিত’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব বিকল্প সংরক্ষণ করছে।’ তিনি বলেন, এর পরিণতি হবে ভয়াবহ এবং চিরস্থায়ী। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এটি জাতিসংঘ সনদের গুরুতর লঙ্ঘন।
ইরানে মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত আরও বিপজ্জনক রূপ নেওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। বিশ্বনেতাদের অনেকে এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। কেউ কেউ উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি এ হামলাকে উত্তেজনাপূর্ণ একটি অঞ্চলে বিপজ্জনক মাত্রায় উত্তেজনা বৃদ্ধির ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এর ফলে এতদঞ্চল ও সারা বিশ্বের জন্যই ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অপরদিকে মার্কন হামলার পর রবিবার ইসরাইলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসরাইলজুড়ে বেশ কিছু স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দেশটি। ইরানের এই হামলার মধ্যে জেরুজালেমে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এই অবস্থায় নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল।
খবর বিবিসি, আলজাজিরা, এমএসএন, ইউএসএ টুডে।
ইরানে হামলা চালানোর আগে মার্কিন বি-২ বেমারু বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে এবং একটানা প্রায় ৩৭ ঘণ্টা উড়ে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায় বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানা বি-২ বিমানগুলো মিসৌরিতে তাদের ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর প্রায় ৩৭ ঘণ্টা ধরে অবিরাম উড়েছিল এবং আকাশে থাকা অবস্থায়ই বেশ কয়েকবার জ্বালানি নেয়। ইরানে মার্কিন হামলায় ১৩৫টিরও বেশি এয়ার ক্রাফ্ট অংশ নেয় বলে জানিয়েছেন মার্কিন জেনারেল ড্যান কেইন।
এ হামলায় ইরানের অত্যন্ত সুরক্ষিত ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে ছয়টি ‘বাঙ্কার-ব্লাস্টার’ বোমা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন থেকে ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে পরমাণু স্থাপনা লক্ষ্য করে ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয়। প্রায় ৪০০ মাইল দূরে অবস্থান করা সাবমেরিন থেকে এসব হামলা চালানো হয়।
কেইন বলেন, হামলায় যেসব বিমান অংশ নেয় তার মধ্যে ছিল বি-২ বোমারু বিমান, যুদ্ধবিমান, জ্বালানি ভরার বিমান এবং নজরদারি করার বিমান। হাশরায় ৭৫টিরও বেশি নির্ভুল ও সুনিপুণ ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ইরানের তিনটি স্থানেই অত্যন্ত গুরুতর ক্ষতি এবং ধ্বংস হয়েছে। কেইন বলেন, মার্কিন বাহিনী উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে এবং ইরানের যে কোনো প্রতিশোধ বা পাল্টা আক্রমণের জবাব দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। তবে ইরান পাল্টা ব্যবস্থা নিলে তা তাদের জন্য অত্যন্ত খারাপ পরিনতি ডেকে আনবে। মার্কন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ এ হামলাকে ‘অবিশ্বাস্য ও অপ্রতিরোধ্য সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
জেনারেল কেইন বলেন, বি-২ স্টিলথ বিমানগুলো ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশের সময় মার্কিন বাহিনী বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে ছিল ভুয়া বিমানের ব্যবহার। চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলো প্রথমে আকাশপথে সামনে এগিয়ে ইরানের যুদ্ধবিমান ও ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়। তিনি বলেন, নাতাঞ্জ ও ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় পৌঁছানোর আগে মার্কিন বাহিনী উচ্চগতির প্রতিরোধ বিমান ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের আকাশে বি-২ বোমারু বিমানের নিরাপদ প্রবেশ নিশ্চিত করে।
এরপর এই অভিযানে নেতৃত্বে থাকা প্রধান বি-২ বোমারু বিমান থেকে ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় দুটি বিশাল আকারের ‘বাঙ্কার-ব্লাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এরপর অন্যান্য বি-২ বিমান তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
ইসরাইলের এক কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওসকে জানিয়েছেন মাটির ২৬২ ফুট গভীরে থাকা পরমাণু কেন্দ্রটিতে হামলা চালাতে ৩০ হাজার পাউন্ডের বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমার প্রয়োজন ছিল। যেটি শুধুমাত্র বি-২ বোমারুরই ছোড়ার ক্ষমতা আছে।
ইরানের মূল পরমাণু কেন্দ্রগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ করা হয়েছে- ট্রাম্প ॥ ইরানের মূল পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলো ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলার পর রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইরানকে এখন শান্তির পথে আসতেই হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের হামলা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক নির্ভুল হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাস-সমর্থক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসা পারমাণবিক হুমকির অবসান ঘটানো। এই হামলা ছিল অসাধারণ সফল একটি সামরিক অভিযান।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, গত ৪০ বছর ধরে ইরান বলে আসছে ‘আমেরিকার মৃত্যু হোক, ইসরাইলের মৃত্যু হোক’। তারা হাজার হাজার আমেরিকানসহ বহু মানুষ হত্যা করেছে এই অঞ্চলে। তিনি ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান কাসেম সোলাইমানির কথাও উল্লেখ করেন, যাকে তিনি ২০২০ সালে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটা আর চলতে দেওয়া যাবে না এবং সেটা আর চলবে না।
তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। ট্রাম্প বলেন, আমরা দল হিসেবে কাজ করেছি, হয়তো এ রকম সহযোগিতা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। আমরা ইসরাইলের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি একদম মুছে দেওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
তিনি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এই অভিযানে অংশ নেওয়া মার্কিন সেনাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আশা করি, ভবিষ্যতে এই ধরনের অভিযানে তাদের আর প্রয়োজন পড়বে না।

 

প্যানেল

×