ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

আগাম বার্তায় প্রস্তুতি

আকস্মিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কমেছে গোয়াইনঘাটের বাসিন্দাদের

ফজলুর রহমান, সিলেট, গোয়াইনঘাট থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ০০:২২, ২৩ জুন ২০২৫

আকস্মিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কমেছে গোয়াইনঘাটের বাসিন্দাদের

সিলেটের গোয়াইনঘাটে বন্যার আগাম প্রস্তুতি ও সতর্কতা প্রচার

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলাটি দেশের অন্যতম বন্যাপ্রবণ উপজেলা। সীমান্ত ঘেঁষা এই এলাকায় হুটহাট পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভেসে যায়। যার কারণে প্রতি বছরই এ উপজেলাবাসী ৬/৭টি আকস্মিক বন্যা মোকাবিলা করতে হয়। আগাম বার্তা না থাকায় এলাকাবাসী আগাম প্রস্তুতিও নিতে পারতেন না। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো এখানকার সাধারণ মানুষকে। তবে বিগত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বন্যার আগাত বার্তা পাচ্ছেন গোয়াইনঘাটের বাসিন্দারা। বার্তা পেয়ে আগাম প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন তারা। ফলে পূর্বের তুলনায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাচ্ছেন উপজেলাবাসী। আর এটি সম্ভব হয়েছে সুফল প্রকল্পের বদৌলতে। কেয়ার বাংলাদেশ, কনসার্নসহ কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার একটি কনসোর্টিয়াম উদ্যোগ সুফল (স্কেলিং-আপ ফোরকাস্ট-বেইজড অ্যাকশন অ্যান্ড লার্নিং ইন বাংলাদেশ) প্রকল্প যা স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়ন করছে উন্নয়ন সংস্থা এফআইভিডিবি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ও লেঙ্গুরা ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাসিন্দার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়েছে। রিমস এনজিও’র পক্ষ থেকে বন্যা, বজ্রপাতের আগাম সতর্ক বার্তা (ভয়েস মেসেজ) এসব নম্বরে পাঠানো হয়। সাড়ে ৩ হাজার বাসিন্দা বন্যার আগাম তথ্য জানিয়ে দেন অন্য বাসিন্দাদের। এতে সবাই আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন, সতর্ক হন। ফলে ২০২৩ সালের শেষের দিক থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এই এলাকায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। শুধু তাই নয়; বন্যার ঠিক আগ মুহূর্তে আগাম প্রস্তুতি নিতে হতদরিদ্র বাসিন্দাদের দেওয়া হয় আর্থিক অনুদানও।
গোয়াইনঘাট নদীর তীর ঘেঁষা বাসিন্দা সুলতানা বেগম। বন্যায় তার বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের একজন তিনি। কথা হয় সুলতানার সঙ্গে। তিনি জানান, বন্যা ও বজ্রপাত হতে পারে, এমন ভয়েস মেসেজ সপ্তাহ খানেক আগে তার ফোন নম্বরে আসে। এই তথ্য তিনি আবার এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেন। ফলে তিনিসহ এলাকাবাসী বাজার থেকে শুকনা খাবার কিনে রাখেন, বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণ করেন, বাচ্চা-বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীদের আশ্রয়ণ কেন্দ্রে নিয়ে যান। ক্ষেতে আধা ফাঁকা ফসল থাকলে তুলে আনেন। গবাদি পশুকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে রাখেন। পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে চলাচলের জন্য নৌকা প্রস্তুত করে রাখেন। সুলতানা বলেন, এখানকার হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে বন্যার ঠিক আগ মুহূর্তে এসব কেনার টাকা থাকে না। তাই সুফল প্রকল্প তাদের কাউকে ৫ হাজার, কাউকে ৭ হাজার করে টাকা দেন। সেই অর্থ দিয়ে বন্যার আগাম বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগাম এমন প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন। ফলে তাদের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমেছে। প্রাণহানিও রক্ষা পেয়েছে। তিনি গত বছর ৫ হাজার করে দুইবার, আর ৭ হাজার করে একবার টাকা পেয়েছেন। এতে অর্থ দিয়ে বন্যা মোকাবিলায় যাবতীয় সরঞ্জাম কিনেছেন। আবার বজ্রপাতের তথ্য দিলে কেউ ঘর থেকে বের হন না। আগে বজ্রপাতে অনেক লোক মারা গেলেও গত দুই বছর এই সংখ্যা কমেছে।
২০২২ সালে এই এলাকায় ভয়াবহ বন্যায় গ্রামীণ সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট যেমন বিধ্বস্ত হয়েছে, সেই সঙ্গে এখানকার বাসিন্দাদের অনেকের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এ রকম ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন সজনা বেগম। সেসময় তার একটি ছাগল মারা যায়। অন্তত ৩০টি হাঁস ভেসে গেছে। এখন মোবাইলে বন্যার আগাম ভয়েস মেসেজ পেয়ে সতর্ক হন তিনি। নেন বন্যা মোকাবিলার পূর্ব প্রস্তুতি। ফলে ২০২৩ সালের পর থেকে কয়েকবার ওই এলাকায় বন্যা হলেও তার তেমন আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সজনা বেগম জানান, পাহাড়ি পানির স্রোত এতো তীব্র থাকে যে, মুহূর্তে এলাকা তলিয়ে যায়। রাস্তা-ঘাট ডুবে যায়। তখন নৌকায় করে আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হয়। কয়েকবার এমন বন্যার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রকল্প থেকে তাকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে। ওই মুহূর্তে সেই অর্থ কোটি টাকার উপকারে এসেছে। নৌকা ভাড়া করে রাখা থেকে শুরু করে যা যা করণীয় তা অনুদানের টাকা দিয়ে করেছেন।  সুফল প্রকল্পের ইউনিয়ন মবিলাইজার মিন্টু রঞ্জন আচার্য বলেন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ওই এলাকার বাসিন্দাদের বন্যার আগাম বার্তা, আগাম প্রস্তুতি নিতে তারা সহায়তা করে আসছেন। এতে লোকমুখে বন্যা আসার তথ্য পেয়ে যান পুরো এলাকাবাসী। তা ছাড়া মসজিদের মাইক ও এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাইকিং করে এ তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে এলাকাবাসী আগাম প্রস্তুতি নেন। ফলে বন্যায় জান, মাল রক্ষা পায়। ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলে হতদরিদ্র ব্যক্তিদের তালিকা ধরে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয় প্রকল্প থেকে।

প্যানেল

×