
জুলাই রেভ্যুলেশন অ্যালায়েন্স তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের এক স্ট্যাটাসে শহীদ ইয়াসিন আহমেদ রাজের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। এই ফেসবুক পেইজটি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন ফুটেজ শেয়ার করে ও ঘটনা বর্ণনা করে।
বলা হয়েছে, শহীদ ইয়াসিন আহমেদ রাজ। শহীদ হওয়ার স্থান-বংশাল, ঢাকা। ৫ই আগস্ট ২০২৪, সোমবার, দুপুর ২ টা।
শহীদ রাজ তখন রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলন করছিলেন, এমন সময়ই শুনতে পান সরকার পতনের সংবাদ। দীর্ঘ ১৬ বছরের যুলুমতন্ত্র চির সমাপ্তির বিজয়ের সুসংবাদ।
শহীদ রাজ আম্মু, ছোট আপু ,আন্টি পরিবারের সবাইকে নিয়েই আন্দোলনে বের হয়েছিলেন। আন্দোলনের আগের দিনগুলোতে আম্মু আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে আম্মুকে বলতেন, আম্মু! আমি কীভাবে ঘরে বসে থাকি! আমার এতগুলো ভাইকে খুনি হাসিনা মেরে ফেলছে।
সবসময়ই অনলাইনে আন্দোলনের পোস্ট করতেন। মৃত্যুর দিনেও ফেসবুক প্রোফাইল পিকটায় ছিলো এক দফার ঘোষণা।
আন্দোলনে বের হওয়ার সময় সকাল ১১ টায় আম্মুর কাছে নুডুলস রান্না করার আবদার করেছিলেন শহীদ রাজ। বিজয়ের দিন সারাক্ষণ আম্মুর সাথে-সাথে থাকা ছোটবেলায় বাবা হারিয়ে ফেলা আম্মুর রাজপুত্রটার এটাই ছিলো আম্মুর কাছে শেষ আবদার।
দুপুর একটায় শাহবাগে আন্দোলনে গিয়ে খুনি হাসিনার পালানোর সংবাদ পেয়ে দুপুর তিনটার দিকে সবাই মিলে বিজয়ের উল্লাসে গণভবনে যান।
সংসদ ভবনে কাজিনের সাথে অনেক ঘুরাঘুরি করেন। তখন গুজব ছড়ানো সংসদ ভবনের পিছনের সেই লাশগুলোর কবরগুলোও দেখে আসেন।
এরপর গণভবনে গিয়ে খুনি হাসিনার পতনটা স্বচক্ষে দেখে বিজয় নিয়েই সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরেন।
রাত আটটা-সাড়ে আটটার দিকে পরিবারের সবার সাথে ডিনার করে বংশালে থাকা নিজের পিকআপ ভ্যানটার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়েন। আজকের মতো এত যুদ্ধের দিনে পিকআপটা ঠিকঠাক মতো আছে কীনা এটা না দেখেই কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। আম্মু বাহিরে যেতে অনেক নিষেধ করেন। কিন্তু শহীদ রাজ আম্মুকে বলেন, আজকে তো দেশ স্বাধীন হইছে। হাসিনা পালাইছে! বাহিরের সবকিছু এখনতো নিরাপদ। এখন তো আর কোন গ্যাঞ্জাম নাই, অবশেষে অনেক এসব কথাবার্তার পর একপ্রকার জোর করেই ভ্যানটা দেখতে বের হন রাত সাড়ে নয়টার দিকে।
রাত এগারোটা! শহীদ রাজের চাচ্চুর কাছে ফোন আসে যে, এই ফোনটার মালিকের নাকি গুলি লেগেছে বংশাল থানার সামনে। কিছুক্ষণ পর চাচ্চু আম্মুকে আবার ফোন দিয়ে জানান যে রাজ আর নেই। কিন্তু আম্মু এটা বিশ্বাস করেন না, ভাবেন নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে ভুল শুনছেন। মিডফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে সবাই পাগলের মতো শহীদ রাজকে খুঁজে বেড়াতে থাকেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হাসপাতালের বাহিরের ফুটপাতে অযত্নে ফেলে রাখা দুইটা লাশ দেখতে পান। মুখের চারপাশে গামচা বাঁধা একটা রক্তাক্ত লাশ যে শহীদ রাজের এটা প্রথমে চিনতে পারেন আম্মু। ঘণ্টা দুয়েক আগে দেখা জলজ্যান্ত ছেলেটাকে হারানো মায়ের কান্নায় কেঁপে উঠে পৃথিবী। সাথে-সাথে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
সেদিন রাত ১ টার দিকে শহীদ রাজকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। লাশ বাসার সামনের রাস্তায় রাখা হয়। রাত ৩ টার দিকে পুলিশের বড় একটা দল আশেপাশের রাস্তা দিয়ে গুলি করতে-করতে যেতে থাকে। গুলির ভয়ে আতঙ্কে শহীদ রাজের আশেপাশে থাকা সবাই লাশটা বাহিরে রেখেই বাসার ভেতরে চলে যেতে বাধ্য হন।
শহীদ রাজের গায়ে পরানো চাদরটা রক্তে ভরে যায়। বারবার কাপড় চেঞ্জ করলেও রক্ত থামছিলো না। এরপর কাফন পরানো হলে কাফনটাও রক্তে ভিজে যায়।
পরেরদিন সকাল ১১টার দিকে জানাজা শেষে শহীদ রাজকে আজিমপুর কবরস্থানে শেষ বিদায় শেষে দাফন করা হয়।
শহীদ রাজের বাবা নেই। ফ্যামিলিতে কেবল এক বোন আর আম্মু। শহীদ রাজ ছিলেন ফ্যামিলির একমাত্র উপার্জনের অবলম্বন। কিন্তু দশমাস পার হয়ে গেলেও শহীদ রাজের পরিবার সরকার এবং জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে একটা টাকাও অনুদান পাননি। অথচ আমরা শহীদ রাজের জন্যই আমাদের স্বাধীনতাটা পেয়েছি।
পুরো নাম:- ইয়াসিন আহমেদ রাজ
জন্মসাল:- ১৯৯৩
শহীদ:- ৫ই আগস্ট ২০২৪
পিতা:- ফারুক আহমেদ
মাতা:- সাহিদা বেগম
পেশা:- পিকআপ ড্রাইভার
শহীদ হওয়ার স্থান:- বংশাল থানার সামনে
যাদের গুলিতে শহীদ:-পুলিশের গুলি পিঠে লেগে সাথে-সাথেই মৃত্যুবরণ করেন।
রিফাত