
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
বাণিজ্যমেলা নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এই মেলার একটি অংশ তরুণদের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। সেখানে তারা তাদের উদ্ভাবন ও ধারণা প্রদর্শন করবেন। উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে দেশের প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় বাণিজ্যমেলার আয়োজন করতে হবে, যাতে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। ঢাকায় মাসব্যাপী চূড়ান্ত প্রস্তুতি বছরব্যাপী দেশের উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করার কথাও জানান প্রধান উপদেষ্টা।
বুধবার রাজধানীর পূর্বাচলে বাংলাদেশ চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে মাসব্যাপী ২৯তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এমন ভাবনার কথা জানান। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ফার্নিচার পণ্যকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তিনি বর্ষ উদ্যোক্তা ঘোষণা করার বিষয়ে তাঁর অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব (চলতি দায়িত্ব) আব্দুর রহিম খান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়ার শক্তি মেলার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে ভবিষ্যতের মেলা হবে দেশজুড়ে জায়গায় জায়গায় এবং ঢাকায় হবে কেন্দ্রীয়ভাবে চূড়ান্ত মেলা। তরুণদের জন্য আমরা সুযোগ তৈরি করে দেব। মেলার প্রস্তুতি সারাবছর ধরে চলবে জেলা ও উপজেলায়। সেখান থেকে বাছাই করা হবে চূড়ান্ত পর্যায়ে মেলায় কারা অংশগ্রহণ করবে। ঢাকার মেলায় একজন আরেকজনকে দেখে শিখবে, বুঝবে এবং বুদ্ধি নেবে।’
বাংলাদেশের তরুণরা সম্ভাবনাময় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, অনেক তরুণ-তরুণী কৃষি, হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, আইসিটিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসায় ভালো করছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা করছে, ঘরে বসে সফটওয়্যার তৈরি করে বিক্রি করছে। কাজেই প্রত্যেক উপজেলায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ জনকে চিহ্নিত করে তাদের তালিকা করা হবে চূড়ান্ত পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য। সারাদেশ থেকে তরুণরা দলে দলে এদের দেখতে আসবে। বিদেশ থেকে আসবে। ঢাকায় মেলায় একজন আরেকজনকে দেখে উৎসাহ পাবে।
প্রধান উপদেষ্টা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীরা কেবল বাংলাদেশের সেরা নয়, তাদের মধ্যে অনেকে দুনিয়ারও সেরা হবে। উপজেলা থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ে আসা তরুণদের খরচ সরকার বহন করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের সমস্ত খরচ সরকার বহন করবে, কারণ তারা তো আমাদের পথ প্রদর্শক। তারা জাতিকে পথ প্রদর্শন করবে। দুনিয়াকে পথ প্রদর্শন করবে। অন্যরা তাদের দেখে শিখবে, বিনিয়োগ করতে আসবে। এখানে বিনিয়োগকারীরা আসবে জানার জন্য, বোঝার জন্য- কোন ব্যবসাটা তার জন্য ভালো হবে।
উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে টাকার অভাব কোন বাধা নয় উল্লেখ করে নোবেলবিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, টাকা নেই, এটা কোনো বিষয় নয়- বুদ্ধি থাকলে টাকা উপার্জন করা যায়। আমরা চাই আমাদের তরুণ-তরুণী, বয়স্ক-বয়স্কা সবাই যেন উদ্যোক্তা হওয়ার শক্তি এই মেলার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারে। তাহলে এই মেলা সবার জীবনে বড় ধরনের প্রভাব রেখে যাবে আমাদের জন্য।
বাংলাদেশ একটা অপূর্ব সুযোগের দেশ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান আরও বলেন, আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, ১৭ কোটি মানুষের একটি দেশ। এর মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ তাজা তরুণ-তরুণী। এ রকম শক্তি খুব বেশি দেশের কপালে নেই। এ কারণে বারে বারে বলছি, এই তারুণ্য শক্তিকে উন্মোচিত করার কথা। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। আরেকটা বিষয় বারে বারে দৃষ্টি আকর্ষণ করি, মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা, শ্রমিক নয়। অন্যের হুকুমে কোনো কিছু সৃষ্টি করা মানুষের পথ নয়। মানুষের পথ হলো নিজে সৃষ্টি করা। নিজের চিন্তায় নিজের ভাবনায় যেটা আসে সেটা তৈরি করা। এই মেলা আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় তরুণদের জন্য আলাদা জায়গা রাখার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাণিজ্যমেলার একাংশ তরুণদের জন্য থাকবে, এখানে ২৫ বছরের নিচে হতে হবে এ রকম একটা শর্ত দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ২৫ বছরের নিচে যারা তারা এখানে কেউ আসবে অন্যের কাছ থেকে শিখতে, আবার কেউ আসবে অন্যকে শেখাতে।
তরুণদের পাশাপাশি তরুণীরা ভালো ভালো ব্যবসা পরিচালনা করছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অনেক তরুণী রয়েছে যারা অসংখ্য কাজ করে। ঘরে বসে শাড়ি বিক্রি করে। গৃহিণী চার-পাঁচ বাচ্চার মা ব্যবসা করে- ঘরে বসে রান্না করে খাবার সরবরাহ করে। অর্ডার দিলে ঠিক সেই আইটেমগুলো রান্না করে সরবরাহ করছে। চমৎকার বুদ্ধি খাটিয়ে এ ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য যারা করছে-তাদের কাজ তুলে ধরতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও রপ্তানি সমৃদ্ধ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, রপ্তানি পণ্যের মান উন্নয়নে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে আরও জোরদার, প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দ্রুততার সঙ্গে সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। বাণিজ্যমেলায় যাওয়ার নিজেদের স্মৃতি তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রথম প্রথম যখন এই মেলা শুরু হলো, কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা; এখানে তিনটি শব্দ। এর মধ্যে কারও আকর্ষণ থাকে আন্তর্জাতিক, কারও বাণিজ্য এবং কারও কারও মেলায়। আমি আগ্রহী মেলায়’ এ সময় অনুষ্ঠানে আগতরা হেসে ওঠেন এবং হাততালি দিয়ে সমর্থন জানান।
প্রতি বছরের মতো এবারও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ইপিবি যৌথভাবে মেলার আয়োজন করেছে। মেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের সম্মানার্থে তৈরি করা হয়েছে ‘জুলাই চত্বর’ ও ‘ছত্রিশ চত্বর’। এ ছাড়া দেশের তরুণ সমাজকে রপ্তানি বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ করতে তৈরি করা হয়েছে ইয়ুথ প্যাভিলিয়ন।
এবার বাণিজ্যমেলায় প্রথমবারের মতো অনলাইনে বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্টল ও প্যাভিলিয়ন স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রথমবারের মতো ই-টিকিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রেতা-দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বিআরটিসির ডেডিকেটেড বাস সার্ভিসের পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছে বিশেষ ছাড়ে উবার সার্ভিস।
এবারের বাণিজ্যমেলায় বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৩৬১টি প্যাভিলিয়ন, স্টল, রেস্টুরেন্ট, দেশীয় উৎপাদক-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠাসহ সাধারণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে শতভাগ স্বচ্ছতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও সাতটি দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠান এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে। মাসব্যাপী এ বাণিজ্যমেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মেলা চলবে।