ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ, পায়রায় কয়লা মজুত আছে ১৫ দিনের

ফের লোডশেডিংয়ের শঙ্কা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৩ মে ২০২৩

ফের লোডশেডিংয়ের শঙ্কা

কয়লা সংকটে আবারও উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বাগেরহাটের রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে

কয়লা সংকটে আবারও উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বাগেরহাটের রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এবার কয়লার অভাবে বন্ধ হতে যাচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রও। ইতোমধ্যে চীনা মুদ্রা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সিএমসিকে কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি আশুগঞ্জের বন্ধ হয়ে যাওয়া দুই ইউনিট। এরই মধ্যে আবার স্ট্রিম পাইপ ফেটে যাওয়ায় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিটের উৎপাদনও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ঈদের আগে দেশজুড়ে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ সংকট মে মাসে আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 
কয়লা সংকটে গত ২৩ এপ্রিল রাত থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের। মূলত ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আবারও উৎপাদন শুরু হবে। এর আগেও কয়লা সংকটের কারণে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার এক মাসের মাথায় আবার উৎপাদনে ফেরে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরে ১৫ এপ্রিল রাত থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আবারও বন্ধ হয় এই মেগা প্রকল্পের উৎপাদন। তিনদিন বন্ধ থাকার পরে ১৮ এপ্রিল সচল হয়।

কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন চালু আর বন্ধের বিষয়টি যেন অনেকটা ইঁদুর-বিড়ালের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরাম উল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, ডলার সংকটে যদি কয়লা আমদানি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো আমাদের করার কিছু নেই। আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টের আওতায় ৬৬০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ৮০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এখন পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫২  মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে।
এদিকে কয়লা সংকটে আর ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ হতে পারে দেশের অন্যতম বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রার উৎপাদনও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডলারের যোগান না থাকায় ১২৪৪ মেগাওয়াটের  কেন্দ্রটির প্রায় ২৯৮ মিলিয়ন ডলার বা ৩২০০ কোটি টাকা কয়লার দাম ৯ মাস বাকি পড়েছে। বকেয়া পরিশোধ না করায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে। পায়রার মজুদ কয়লা দিয়ে আর মাত্র ১৫ দিন চলবে। এর পরই বন্ধ হয়ে যাবে দেশের সব থেকে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।

কেন্দ্রটিতে দিনে ১০ হাজার টন ও মাসে প্রায় ৩ লাখ টন কয়লা লাগে। এর পুরোটাই ইন্দোনেশিয়া  থেকে আমদানি করা হয়। পায়রার বিদ্যুৎ বরিশাল ছাড়াও ঢাকায় আসে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কেন্দ্রটিতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বড় লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে দেশ। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হলে সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি  হবে ঢাকা ও বরিশালে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সূত্রে জানা যায়, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাকিতে কয়লা কেনে। ছয় মাস পরে কয়লার দাম পরিশোধ করতে হয়। কেন্দ্রটির সমান মালিকানা রয়েছে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএমসির কেন্দ্রটিতে যে কয়লার প্রয়োজন হয় তার যোগান দেয় চীনের সিএমসি। তবে সিএমসির কাছে বাকিতে কয়লা  কেনে পায়রা।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২৭ মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লার বকেয়া ওভারডিউ হয়েছে ২৯৮ মিলিয়ন বা প্রায় ৩২০০ কোটি টাকা। বাকির টাকা দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় চীনের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর ফলে মে মাসে কয়লা আমদানির কোনো ঋণপত্র খুলতে পারবে না সিএমসি। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার মজুদ দিয়ে বড়জোর মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চালানো সম্ভব হবে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গড়ে প্রতিমাসে ৩ লাখ টন কয়লার দরকার হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২৯৮ মিলিয়ন ডলার বকেয়া থেকে গত এপ্রিলে ৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধ (এলসি মীমাংসা) করা হলে সিএমসি মে মাসের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা সরবরাহ করতে পারবে। ডলারের যোগান চেয়ে বারবার সোনালী ব্যাংককে চিঠি দিয়েও ডলারের যোগান হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তারা।
এর মধ্যেই আবার স্ট্রিম পাইপ ফেটে যাওয়ায় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিটের উৎপাদন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায় গত শুক্রবার রাতে। প্রতিদিন এ ইউনিট থেকে ২৭০-২৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। উৎপাদন বন্ধের বিষয়ে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক জনকণ্ঠকে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার দিক থেকে তৃতীয় ইউনিটের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এটা মেরামত করতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগবে। তবে ১ নম্বর ইউনিটের উৎপাদন সচল রয়েছে।

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে গড়ে ওঠা কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের মধ্যে এক নম্বর ইউনিটের উৎপাদন চালু আছে। ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ ইউনিট থেকে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এটি সচল রাখতে দৈনিক ৯০০ থেকে এক হাজার মেট্রিকটন কয়লা লাগে। আর দ্বিতীয় ইউনিটটি সংস্কারের জন্য ওভারহোলিংয়ের কাজ চলছে।
একইভাবে বন্ধ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্ট ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন। ট্রিপ করায় এর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে জানিয়ে এই ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল মজিদ জনকণ্ঠকে বলেন, একটি লাইন ট্রিপ করে গত ২৫ এপ্রিল। গত শনিবার সিমেন্স থেকে প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করে গেছে। মেরামতের কাজ চলছে। আশা করছি, শীঘ্রই এর উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে। 
পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, দেশে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। দিনেরবেলা ১২ হাজার মেগাওয়াট, সন্ধ্যার পর রাত ১১টা পর্যন্ত ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে সরবরাহের সঙ্গে চাহিদার একটা বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুতের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল থাকলেও সারাদেশে বিদ্যুতের পরিস্থিতি অসম্ভব খারাপ হয়েছে।
যদিও সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা শুরু করেছে। এর প্রভাব পড়েছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে। দেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ পরিমাণ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে। তবে রামপাল, পায়রা, বড়পুকুরিয়া, আশুগঞ্জের মতো কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বিঘ্নিত হলে লোডশেডিং আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। 
পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, পায়রার বিদ্যুতের বড় অংশ ঢাকায় আসে। লোডশেড সামাল দিতে সরকার ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু করেছে। কিন্তু এই ধরনের কেন্দ্র একনাগাড়ে চলতে পারে না, ৭/৮ ঘণ্টা চালু থাকার পর এসব কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু পায়রার মতো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র একনাগাড়ে মাসের পর মাস চলতে পারে এবং একই উৎপাদন দিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে গোটা বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় সংকট তৈরি হবে।
তাই এ বিষয়ে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে দাবি করে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎ আমরা কিনছি বেশি দামে। আর যে কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম সেটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কয়লা আমদানির অভাবে। ছয় মাসের বেশি বাকি পড়েছে। এই পরিস্থিতি একটি গণনৈরাজ্যের ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেন, সরকারের হাতে থাকা সব ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রেখেও লোডশেডিং সামাল দিতে পারছে না। কারণ, এ বছর চাহিদা পিক আওয়ারে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ১১ টা পর্যন্ত  সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।  আর এ সময়  উৎপাদন হচ্ছে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। গড়ে দিনে ও রাতে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ঘণ্টাপ্রতি ১২ হাজার মেগাওয়াট আর এ সময় গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ঘণ্টাপ্রতি (২৪ ঘণ্টা দিনে-রাতে) ৯ হাজার ৭০০  থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে যদি ১২৪৪ মেগাওয়াটের মতো সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর বড় ঝুঁকি তৈরি করবে।

×