.
জেলার পাঁচ সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে বড় আসন হচ্ছে পাবনা-৩ (চাটমোহর-ভাঙ্গুরা)। জেলার প্রাচীনতম উপজেলার একটি হচ্ছে এই চাটমোহর। উপজেলাটি ঐতিহ্যবাহী চলন বিল অধ্যুষিত। রেলপথ, নদীপথ ও সড়কপথের সুব্যবস্থা থাকায় পাবনা জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে চাটমোহর উপজেলা ব্যবসাপ্রসিদ্ধ উল্লেখযোগ্য একটি উপজেলা। চাটমোহর উপজেলার ১১ ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা, ভাঙ্গুড়া উপজেলার ছয় ইউনিয়ন, এক পৌরসভা ও ফরিদপুর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা নিয়ে এ আসনটি গঠিত। জেলার এই সর্ববৃহৎ আসনেও বইতে শুরু করেছে আগামী নির্বাচনের হাওয়া। নির্বাচনের এখনো দশ মাস বাকি থাকলেও সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানা কৌশলে ভোটারদের মন জয় করতে মাঠে নেমেছে। প্রায় প্রতিদিনই নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থিতার জানান দিচ্ছে। তবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আসনটিতে এবার মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ আসনে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ১২ জন, বিএনপির ছয় জনসহ দেড় ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছে। প্রার্থীর ছড়াছড়ি হওয়ার কারণে এ আসনে বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুদলেই রয়েছে কোন্দল ও গ্রুপিং। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে প্রার্থীদের মধ্যে ততই গ্রুপিং বাড়বে বলে দলীয় সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রওশনুল হক মতি। এরপর ১৯৭৯ সালে বিএনপির জমশেদ আলী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে ওয়াজি উদ্দিন খান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এ কে এম সামসুদ্দিন।
১৯৯১ সালে বিএনপি প্রার্থী বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আযম আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশন সভাপতি ওয়াজি উদ্দিন খানকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াজি উদ্দিন খান বিএনপি প্রার্থী কে এম আনোয়ারুল ইসলামকে হারিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য হন। ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী কে এম আনোয়ারুল ইসলাম আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনকে হারিয়ে বিজয়ী হন।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন বিএনপি প্রার্থী গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব) সাইফুল আযমকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালেও জয়ী হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনবারের সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের অন্যতম মনোনয়নপ্রত্যাশী।
তিনবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আলহাজ মকবুল হোসেন নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করলেও কিছু কিছু ঘটনায় তাঁর কর্মকান্ডে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। বিশেষ করে দলীয় ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে নিজের ছেলেকে মেয়র বানানো, দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করাসহ নানা বিষয়ে তৃণমূলে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে।
স্থানীয় সরকারের উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করারও অভিযোগ করেছেন অনেকে। এ ছাড়া সাংগঠনিক কর্মকান্ডেও সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের গরহাজির নিয়েও নানা সমালোচনা রয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এসব মান-অভিমান দ্রুত অবসান না করতে পারলে আগামী নির্বাচনে সেটি বিরূপ প্রভাব ফেলার সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকেই। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের দাবি, সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের বিপুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়েই একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি চতুর্থবারের মতো জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবেন বলেই তাঁদের দাবি।
সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন ছাড়াও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চাটমোহর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাস্টার এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনিও এ আসনে জনসংযোগ চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাস্টার জানান, দলীয় সভানেত্রী মানবতার মা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দিলে তিনি এ আসনটি দলকে উপহার দিতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদী।
পাবনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আব্দুর রহিম পাকনও এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। দলীয় সভানেত্রী তাঁকে মনোনয়ন দিলে তিনি অবশ্যই বিজয়ী হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় আরও আছেন- কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কৃষি সমবায় বিষয়ক উপকমিটির সদস্য মেজর জেনারেল (অব) ড. ফসিউর রহমান, চাটমোহর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা চাটমোহর পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন সাখো, চাটমোহর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম নজরুল ইসলাম, চাটমোহর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় সদস্য ঢাবি ছাত্রলীগ সাবেক নেত্রী উমেদা জাবীন সমাজী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল আলিম, পাবনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অ্যাডভোকেট শাহ আলম, ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সরকার, ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলী আশরাফুল কবীর ও ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র খ ম কামরুজ্জামান মাজেদ।
অন্যদিকে, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী তালিকায় রয়েছেন- চাটমোহর বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক এমপি কে এম আনোয়ারুল ইসলাম, পাবনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও পাবনা বার সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাকসুদুর রহমান মাসুদ, চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাসাদুল ইসলাম হীরা, ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মো. বাকী বিল্লাহ, ভাঙ্গুড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আলহাজ মো. রাজিবুল হাসান বাবু ও ফরিদপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম বকুল।
বিএনপিতেও অধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর কারণে স্থানীয়ভাবে দলটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব রয়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এলাকায় নিজ নিজ পক্ষের নেতাকর্মী, সমর্থকদের নিয়ে আলাদাভাবে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হলে দুই দলের জন্যই তা বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা দেখছেন দল দুটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তবে আগামী নির্বাচনে এই আসনে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে দুই দলের নেতাকর্মীরাই মনে করছেন।