ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব ক্যান্সার দিবস আজ

দেশে ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী বছরে মৃত্যু দেড় লাখ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০১:২০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দেশে ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী বছরে মৃত্যু দেড় লাখ

.

অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, অতিরিক্ত ধূমপান, মাদকগ্রহণ, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিশ্ব ক্যান্সার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গ্লোবকোনের (জিসিও) তথ্যমতে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। এর বাইরে প্রতিবছর আক্রান্ত হচ্ছেন দুই লাখ মানুষ। এদের বেশিরভাগেরই শনাক্ত হয় একেবারে শেষ সময়ে। ফলে প্রতিবছর ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় অন্তত দেড় লাখ মানুষের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এতসব রোগীর জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২০০ জন। অর্থাৎ একজন চিকিৎসককেই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ক্যান্সার রোগীকে। বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার দেশজুড়ে পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস।
সারাবিশ্বে ক্যান্সারের চিত্র ও প্রতিপাদ্য ॥ গ্লোবকোনের মতে সারাবিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্তের চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। মারা যান এক কোটিরও বেশি মানুষ। এমন অবস্থায় ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছরের মতো পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিমিত জীবন-যাপন, ধূমপান পরিহার, ব্যায়ামসহ কিছু নিয়ম মেনে চললে যেকোনো ধরনের ক্যান্সার থেকে নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব।
‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’ অর্থাৎ ‘বৈষম্য কমাই ক্যান্সার সেবায়’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যে সারাবিশ্বের মতো দেশেও পালিত হচ্ছে এ দিবস। এ উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি। ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল নামের একটি বেসরকারি সংস্থার নেতৃত্বে উদযাপন করা হচ্ছে দিবসটি যা পূর্বে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন নামে পরিচিত ছিল। এই সংস্থার সদর দপ্তর জেনেভায়। ১৭০টিরও বেশি দেশে প্রায় দু’হাজার সদস্য রয়েছে সংস্থার।
ক্যান্সার দিবস পালনের উদ্দেশ্য ॥ দিবসটি আয়োজনের সঙ্গে জড়িতরা বলছে, ক্যান্সার দিবস পালনের উদ্দেশ্য হল মারাত্মক ও প্রাণঘাতী এই কর্কট রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। চিকিৎসকরা মনে করেন, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের রোগ তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে এবং সেক্ষেত্রে চিকিৎসা সহজ হয়। ক্যান্সারের লক্ষণগুলো নির্ভর করে ক্যান্সারটি কোথায়, এটি কতটা বড় এবং এটি কাছাকাছি কোনো অঙ্গ বা টিস্যুকে কতটা প্রভাবিত করে কি না। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে শরীরের বিভিন্ন স্থানে লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তারা বলেন, ক্যান্সার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এটা কী ধরনের রোগ, কী কী কারণে ঝুঁকি বাড়ে, প্রতিরোধের জন্য কী কী করণীয় সে বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।
ক্যান্সার হাসপাতালের গবেষণা প্রতিবেদন ॥ দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। শুধু জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালেই গত তিন বছরে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৮৩ হাজার ৭৯৫ রোগী। যাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৭৩৩ জন রোগীর শরীরে। যা শতাংশের হিসেবে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। সম্প্রতি হাসপাতালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রোগীদের মধ্যে ১৯ হাজার ৫৪৬ জন (৫৫ শতাংশ) পুরুষ ও ১৬ হাজার ১৮৭ জন (৪৫ শতাংশ) নারী। পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের রোগী বেশি। যা মোট রোগীর প্রায় ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর নারী রোগীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। যা শতাংশের হিসাবে ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
ক্যান্সার চিকিৎসক মাত্র ২২০ জন ॥ প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২০০ জন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ছাত্র ভর্তির পাশাপাশি পড়ানো হয়- এমন সব প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সার বিষয়টির নামের ভিন্নতা থাকায় চিকিৎসক নিয়োগে জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতা দ্রুততম সময়ে নিরসনের দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ২০০ জন, জনসংখ্যার তুলনায় যা অপ্রতুল। বিএসআরওর মতে পাঁচ হাজার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসক নিয়োগ বাড়িয়েছি। কিন্তু এটি সব জায়গায়ই বাড়ানো দরকার।
প্রতিষেধকের চাইতে প্রতিরোধ জরুরি ॥ ক্যান্সার একবার হয়ে গেলে মানুষের অর্থ-প্রতিপত্তি সব একে একে শেষ হয়ে যায়। তাই এটি হওয়ার আগে এর প্রতিরোধ জরুরি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যান্সার যেন না হয় সেজন্য মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ক্যান্সার প্রতিরোধে নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর গুরুত্ব দেওয়া এবং ধূমপান পরিহার করতে হবে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোসহ নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, অসংক্রামক রোগে যদি ৬৭ শতাংশ মানুষ মারা যায় তাহলে তার ১০ শতাংশ ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আমাদের প্রকৃত ক্যান্সার রোগী কেমন তা আমরা জানি না। আমাদের কাছে তথ্য আছে, কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সামগ্রিক যে তথ্য দরকার একটি দেশের জন্য সেটা কিন্তু আমরা জানি না। ধরে নেওয়া হচ্ছে, প্রতিবছর দুই লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তার ৬০ শতাংশের বেশি মারা যাচ্ছে।
বছরজুড়ে নষ্ট থাকে রেডিওথেরাপি মেশিন ॥ দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। স্বলমূল্যে প্রায় সব ধরনের ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা পাওয়ায় সারাদেশ থেকে এই হাসপাতালে আসেন রোগীরা। ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের আশায় রোগীরা এই হাসপাতালে প্রতিদিনই ভিড় করলেও খোদ হাসপাতালটিই যেন ক্যান্সারে আক্রান্ত। হাসপাতালটিতে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ছয়টি। কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে এর পাঁচটিই নষ্ট। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে আবার কয়েকটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়েছে ব্যবহারের কার্যকারিতা। নেই একটিও এমআরই মেশিন। হাসপাতালজুড়ে রয়েছে মাত্র একটি এক্সরে মেশিন। সেটিও নষ্ট এক বছরের বেশি সময় ধরে। সর্বোপরি রয়েছে তীব্র জনবল সংকট। ৩শ’ বেডের হাসপাতালের জনবল নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ৫শ’ বেডের বিশাল এই হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম। ফলে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
প্রায় একই অবস্থা অন্যান্য হাসপাতালগুলোর অনকোলজি বিভাগেরও। খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই রেডিওথেরাপির মেশিন চালু রয়েছে মাত্র একটি। এতে করে একজন রোগীর সিরিয়াল পেতে এক বছরও পার হয়ে যায়।
অবকাঠামোর সঙ্গে উন্নত যন্ত্রপাতি স্থাপনের তাগিদ ॥ শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয় বরং মরণব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে ক্যান্সার রোগতত্ত্ববিদ ও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজি বিভাগের সদ্য সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ক্যান্সার হওয়ার আগে যদি এটির স্ক্রিনিং করা যায় তাহলে পুরো পরিবার বেঁচে যায়। দিনের পর দিন আমাদের ‘হাই-রাইজ’ সব ভবন হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অর্জন করেছে। কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সেই মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতিই ব্যবহার হচ্ছে এখনো। ফলে রোগীদের উপকার হওয়ার বদলে কষ্টই বাড়ছে বেশি।
চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ ॥ দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা সুবিধায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ক্যান্সার ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। ৫০ শয্যা থেকে প্রথমে ৩০০ বেডে, বর্তমানে ৫০০ বেডে সম্প্রসারিত হয়েছে। শুধু রেডিওথেরাপি বিভাগ দিয়ে শুরু হলেও আধুনিক বিশ্বের মতো সার্জারি, কেমোথেরাপি, গাইনি, শিশু ক্যান্সার বিভাগসহ অনেক বিভাগ সংযোজিত হয়েছে। প্রতিরোধ ও গবেষণার জন্য ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজি বা রোগতত্ত্ব বিভাগ হয়েছে। ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য আলাদা কয়েকটি বিভাগ হয়েছে। বেসরকারি বেশকিছু হাসপাতাল উন্নতমানের ক্যান্সার চিকিৎসা সুবিধা চালু করেছে।
তবে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় বিপুলসংখ্যক ক্যান্সার রোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডা. এটিএম কামরুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, বেসরকারি বড় হাসপাতালগুলোতে সেবার উচ্চমূল্যের জন্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। একমাত্র সরকারি সমন্বিত বিশেষায়িত ক্যান্সার ইনস্টিটিউট সাধারণ মানুষের ভরসা স্থল। তবে সারাদেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক রোগীর কারণে দীর্ঘ অপেক্ষমান তালিকা দূর-দূরান্তের মানুষের অনেক কষ্টের কারণ। তাই চিকিৎসা সুবিধা মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে বিকেন্দ্রীকরণের। তবে তা বাস্তবায়ন জরুরি।
দিনজুড়ে যত আয়োজন ॥ দিবসটি উপলক্ষে আজ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বাংলাদেশ ক্যান্সার ফাউন্ডেশনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচি পালন করবে। এরমধ্যে শোভাযাত্রা, ক্যান্সারবিষয়ক পোস্টার ও ফেস্টুন প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, ক্যান্সার রোগী ও সারভাইবারদের অংশগ্রহণে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অন্যতম।

 

×