অপূর্ব কুমার ॥ রক্ষক হচ্ছে ভক্ষক। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ও শেয়ারের প্রাথমিক জিম্মাদার হিসেবে ব্রোকারেজ হাউসগুলো দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারাই এখন লোভে নিজেদের জিম্মায় থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। ঠকাচ্ছেন নিরীহ বিনিয়োগকারীদের। গত দেড় বছরে তিন ব্রোকারেজ হাউসের অনিয়মের কারণে লেনদেন বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। বিনিময়ে ফেরত পেয়েছে সামান্য অর্থ। এমনকি কোন কোন ব্রোকারেজ হাউসে বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক জমাও লাপাত্তার অভিযোগ রয়েছে।
শেয়ার কেনা-বেচার ক্ষেত্রে কমিশনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা জিম্মাদার হিসেবে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স এ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব) খুলে থাকেন। এজন্য বিও হিসাব পরিচালনা বাবদ ব্রোকারেজ হাউসটি ৪৫০ টাকা চাঁদা নিয়ে থাকেন।
সেই জিম্মাদাররাই প্রতারণার মাধ্যমে টাকা ও শেয়ার আত্মসাত করছেন। তারা অর্থ ফেরত পেতে আন্দোলন ও কর্মসূচীতে যাচ্ছেন। হারানো অর্থ পেতে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেছে তামহা সিকিউরিটিজের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। সংবাদ সম্মেলনে তারা অর্থ আত্মসাতের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের গাফিলতিকে দায়ী করেন। তারা বিদেশে ‘রোড শো’ করে নতুন বিনিয়োগকারী আহ্বান করার চাইতে দেশের বাজারে থাকা বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা দাবি করেন।
সম্প্রতি ডিএসইর একটি ব্রোকারেজ হাউসের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ব্রোকারেজ হাউসটির নাম তামহা সিকিউরিটিজ। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউসটির লেনদেন কার্যক্রম গত ২৯ নম্বেবর থেকে স্থগিত রেখেছে ডিএসই। আরও কয়েকটি হাউসের লেনদেন বন্ধ রয়েছে। ব্রোকারেজ হাউসগুলো হলো ঃ ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ, তামহা সিকিউরিটিজ, ডন সিকিউরিটিজ, ইনডেক্স সিকিউরিটিজ, এ্যালায়েন্স সিকিউরিটিজ ও সগির সিকিউরিটিজ।
বর্তমান কমিশনের আমলে লেনদেন বন্ধ হওয়া তিন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীরা ৬৬ কোটি ৬ লাখ ১৭ হাজার ১০১ টাকা পাওনা দাবি করে ডিএসইকে জানিয়েছেন। হাউস তিনটি হলো ঃ ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ ও তামহা সিকিউরিটিজ।
বিনিয়োগকারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ৮০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ।
প্রাথমিকভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউসে এ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ব্রোকারেজ হাউসে টাকা অথবা চেক জমা রেখে তাদের শেয়ার কেনা-বেচা করতে হয়। তাদের কাছে নিজের কষ্টের টাকা জমা করেই মুনাফার চিন্তা করতে হয়। কিছু ব্রোকারেজ হাউস কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের টাকা ও সিকিউরিটিজ আত্মসাতের জন্ম দিয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ (সিডিবিএল) সম্প্রতি প্রতিটি বিনিয়োগকারীদের প্রতি মাসে ই-স্ট্রেটমেন্ট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আগে থেকেই প্রতিদিনের শেয়ার কেনা-বেচার হিসাব প্রতিটি বিনিয়োগকারীর মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাব পাঠানো হতো। হাউস কর্তৃপক্ষ সু-কৌশলে সিডিবিএলকে বাদ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করেছে। পরে টাকা লাপাত্তার ঘটনা ঘটেছে। তাই সিডিবিএলের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে যে, সিডিবিএল আরও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে আগামীতে এই ধরনের জালিয়াতি যেন না হয়।
এর আগে কাজী একুইটিস লিমিটেডের জাহিদ হাসান নামের এক বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রির ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠানটি কিছু না জানিয়ে তার সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়। বারবার বলার পরও পাননি প্রতিকার। একপর্যায়ে ব্রোকারেজ হাউসের প্রতারণার এ বিষয়টি জানিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করেন। অধিদফতরের শুনানিতে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বিনিয়োগকারীকে শেয়ার ফেরত দিতে বাধ্য হয় কাজী একুইটিস।
বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. শিবলী রূবাইয়াত-উল-ইসলাম সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএলের) বিনামূল্যে মাসিক প্রতিবেদন পাঠানোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্রোকারেজ হাউসের অনিয়ম নিয়ে বলেছেন, আমরা ব্যবসাবান্ধব সেবা দিতে চাই। আর সেবা দিতে গিয়ে মানুষের অসততার কারণে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। এই হার আরও হয়ত কম হবে। এই ২-৩ শতাংশ মানুষের কারণে পুরো ৯৭ শতাংশ মানুষকে কষ্ট পেতে হয়। তাদের জন্য অন্য রকম নিয়মকানুন বানাতে হয়।
ব্রোকারেজ হাউসের টাকা আত্মসাত ও শেয়ার বিক্রির ঘটনায় খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. ইউনুসুর রহমানও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ বিশ্বাস করে শেয়ারবাজারে গেলে টাকা আত্মসাত হয়। তাদের ঠকানো হয়, এটিই বর্তমান শেয়ারবাজারের দুর্বলতা। আমাদের এই দুর্বলতা কাটিয়ে মানুষের মাঝে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।