
গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে প্রকৃতির রঙহীনতায় যখন চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তখনই যেন প্রাণের ছোঁয়ায় ভরে ওঠে চারপাশ—সোনালি রঙে সেজে ওঠে রাস্তাঘাট, স্কুল প্রাঙ্গণ কিংবা গাছপালা ঘেরা মাঠ। সে রং ছড়িয়ে দেয় এক নয়নাভিরাম ফুল—সোনালু, যা এখন বিলুপ্তির পথে।
একসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে সড়কের ধারে, গ্রামীণ বন-বাদাড়ে, বাড়ির আঙিনায় কিংবা বিদ্যালয়ের আশেপাশে চোখে পড়ত অসংখ্য সোনালু গাছ। এই গাছের ঝুলন্ত সোনালি ফুল গ্রীষ্মে হয়ে উঠত প্রকৃতির এক অপূর্ব অলংকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজ এই দৃশ্য আর খুব একটা দেখা যায় না। কালের বিবর্তনে এবং মানুষের অসচেতনতার কারণে সোনালু ফুল আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
দেখতে কিশোরীর কানের দুলের মতো ঝুলে থাকা এই ফুলগুলো যখন মৃদু বাতাসে দুলতে থাকে, তখন প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন এক নতুন মাত্রা পায়। সবুজ কচি পাতার ফাঁকে ঝলমলে সোনালি ফুল প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে অনন্যভাবে। সোনালুর ইংরেজি নাম ‘Golden Shower Tree’ এবং বৈজ্ঞানিক নাম Cassia fistula। এ ফুলকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন ‘অমলতাস’—যা আজও হিন্দি ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই গাছের আদি নিবাস হিমালয় অঞ্চলে হলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারজুড়ে এর বিস্তৃতি রয়েছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের উষ্ণ অঞ্চলেও এই গাছ পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি উপজেলায় একসময় সৌন্দর্য ছড়াত এই সোনালু গাছ, তা এখন হাতেগোনা কয়েকটিতে এসে ঠেকেছে। কারণ একটাই—নির্বিচারে গাছ কাটা, বন উজাড় এবং সচেতনতার অভাব।
তবুও এখনো কিছু জায়গায়, যেমন বাঞ্ছারামপুর পৌরসভার দশদোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভেতরে, সৌন্দর্য ছড়াতে দেখা যায় সোনালু ফুলকে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এই সোনালি সৌন্দর্য উপভোগ করেন। দশদোনা স্কুলের সহকারী শিক্ষক দ্বীন মোহাম্মদ দিপু বলেন, “আমাদের স্কুলের ভিতরে সোনালু ফুলের গাছ রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা তা দেখে খুবই আনন্দ পায়। কেউ কেউ সেলফি তোলে, কেউ আবার কবিতা লেখে।”
গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে প্রাণের সজীবতা নিয়ে সোনালু যখন ফুটে ওঠে, তখন মনে হয় প্রকৃতির এক সজীব উৎসব শুরু হয়েছে। পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ে এই রঙিন ফুলের বাহার। কেউ কেউ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে যান, মোবাইলে বন্দি করেন প্রকৃতির এই রূপসি দৃশ্য। এ যেন প্রকৃতির রূপকন্যা হলুদের পিঁড়িতে বসে চারপাশে আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
শীতকালে সোনালু গাছ পত্রশূন্য হয়ে পড়ে, বসন্তের শেষ দিকে গজায় নতুন পাতা, আর গ্রীষ্মে গাছ ভরে যায় ফুলে। এর ফল দেখতে অনেকটা লাঠির মতো, যা থেকে বীজ পড়ে প্রাকৃতিক নিয়মে নতুন গাছ জন্মায়। কিন্তু সমস্যা হলো—মানুষ এখন আর এই গাছ রোপণ করে না। বন, ঝোপঝাড়ে স্বাভাবিকভাবে গজিয়ে ওঠা গাছও মানুষ কেটে ফেলছে নির্বিচারে।
এক সময় গ্রামীণ এলাকাগুলোতে পুকুর পাড়, মসজিদ-মাদ্রাসার পাশে, মাঠের কিনারায় কিংবা বাড়ির আঙিনায় সৌন্দর্য ও ছায়ার জন্য সোনালু গাছ রোপণ করা হতো। এখন মানুষ ফলদ বা বাণিজ্যিক গাছের দিকে ঝুঁকছে বেশি, ফলে বনজ ও সৌন্দর্যবর্ধক বৃক্ষগুলো অবহেলিত হয়ে পড়েছে।
তবে সোনালু শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এর রয়েছে ঔষধিগুণও। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, এই গাছের ছাল, ফুল এবং ফল নানা ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পেটের রোগ, জ্বর ও রক্ত বিশুদ্ধিকরণে এর উপাদান উপকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয় বহু আগে থেকেই।
এই গাছ ও ফুলকে বাঁচাতে প্রয়োজন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ।পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়ে উদ্যোগ নিলে আবারও সোনালুর সোনালি রঙে ভরে উঠতে পারে আমাদের চারপাশ। বিদ্যালয়ের পরিবেশ শিক্ষায় গাছ লাগানোর অংশ হিসেবে সোনালু গাছ রোপণের উদ্যোগ নিতে পারে কর্তৃপক্ষ। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোরও উচিত—স্থানীয় প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করা।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ গাছ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। জেলা বা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে সোনালুকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে।
আজকের দিনে যখন চারপাশে জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বনভূমি সংকোচন, তখন প্রকৃতির প্রতিটি গাছই আমাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। সৌন্দর্য, ছায়া, ওষুধ, এমনকি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সোনালুর অবদান অনস্বীকার্য। এই গাছ যেন হারিয়ে না যায় ইতিহাসে—সে জন্য আমাদের করণীয় এখনই ঠিক করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, সোনালু ফুল কেবল একটি গাছ বা ফুল নয়, এটি আমাদের শৈশবের স্মৃতি, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আর রঙের মহোৎসব। তার এই রূপ-গুণের মর্যাদা রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক
সজিব