
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওরা কখনও নিজেদের কয়েন প্রত্নতাত্ত্বিক দাবি করেন, আবার কখনও নিজেরাই বিক্রেতা, রসায়নবিদ সেজে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। গুলিস্তান থেকে ৪০-৫০ টাকা দামের তামার কয়েন কিনেন। এরপর চোরাই তামার তার গলিয়ে প্রলেপ দিয়ে তৈরিকৃত কয়েনগুলো হয়ে যায় দুর্লভ ম্যাগনেটিক কয়েন। সেগুলোর ৪০০ বছরের পুরানো কয়েন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে কোটি টাকার দাম তুলতো প্রতারক চক্রটি। এদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। এ রকমই একটি প্রতারক চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের গুলশান জোনাল টিম। রাজধানীর উত্তরা, সাভার এবং মানিকগঞ্জে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, সাইফুল ইসলাম ওরফে বিষ্ণু মালো ওরফে শঙ্কর মালো ওরফে শঙ্কর ওরফে স্বপন, সাইদুল ইসলাম জিহাদ ওরফে রাজা, সৈয়দ মুস্তাকিন ওরফে অহিদুজ্জামান ও মতিন মোল্লা ওরফে মোল্লা আতিক। এ সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ১১ লাখ টাকা এবং ৪২টি বিভিন্ন আকৃতির ধাতব মুদ্রা যাতে ইন্ডিয়া কোম্পানি, এক আনা, দুই আনা এবং বিভিন্ন প্রতিকৃৃতি খচিত আছে।
ডিসি ডিবি গুলশান বিভাগে মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এই চক্রের ৮/ ৯ জন সদস্য থাকে। তাদের মধ্যে ২/৩ জন থাকে যারা বিত্তবান, সহজ, সরল কিন্তু লোভী লোকদেরকে টার্গেট করে তাদের আত্মীয়দের বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে বুঝায় যে, তারা একটা দুর্লভ মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব পেয়েছে যা বিক্রি করলে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে। এই দুর্লভ জিনিসটিকে দেশ-বিদেশে বিক্রয় করার জন্য একজন স্মার্ট এবং প্রভাবশালী লোকের প্রয়োজন। এদের অন্য দলে থাকে একজন বিদেশী যে অনর্গল হিন্দী এবং ইংরেজীতে কথা বলে। মাড়োয়ারি সাজা এ বিদেশী ব্যবসায়ী বাংলাদেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্বসামগ্রী উচ্চমূল্যে কেনার অভিনয় করে। চক্রের অপর দলে থাকে অন্তত একজন রেডিওলজিস্ট, যে বিদেশী ব্যবসায়ীদের পক্ষে মুদ্রাসহ ধাতব পদার্থ কেমিক্যাল দিয়ে পরীক্ষা করে তার বয়স এবং ধরন বলে দিতে পারে।
টার্গেটের সঙ্গে সমঝোতা হলে যে কোন দিন বিকেলে চক্রটি টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে বসে। সেখানে আলোচনা হয় যে, ধাতব বস্তু/মুদ্রাটি কোন এক জেলার গ্রামে আছে এবং তার একটা বর্ণনা দেয়া হয়।
প্রতারক চক্রের আরেক দালালের বর্ণনা শুনে বিদেশী ব্যবসায়ীর পক্ষে তার এজেন্ট বস্তুটিকে ঢাকায় এনে পরীক্ষা করানোর জন্য আরেকটা ডেটের প্রস্তাব করে। এ সময় প্রতারকচক্র একজন রসায়নবিদ সেজে সেই ডেটে হোটেলে ওই ধাতব মুদ্রা পদার্থটিকে পরীক্ষা করে একটা পর্যায়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে বলে এটির বয়স ৩০০ থেকে ৪০০ বছর। তখন বিদেশী সাজা প্রতারক ছটফট করতে থাকে এটাকে কেনার জন্য। দুর্লভ এই মুদ্রা বা ধাতব বস্তুর মালিক সম্ভাব্য ভিকটিমকে হাত-পা ধরে বলতে থাকে বিদেশীদের সঙ্গে বার্গেনিং করে তারা পারবে না। বিদেশীরা ঠকিয়ে দেবে। তাই একটা এগ্রিমেন্ট করে বস্তুর মালিক প্রতারকরা সম্ভাব্য ভিকটিম ব্যবসায়ীকে বস্তুটি বুঝিয়ে দিতে চায় এবং তার কাছ থেকেই বিক্রয়লব্ধ টাকা পেতে চায়।
কথিত ৪০০ বছরের পুরানো দুটি কয়েনের দামে ক্রেতা সন্তুষ্ট হয়ে ৪০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন। এরপর বাকি টাকা পরিশোধের তারিখ ঠিক করে নেন বিদায়। নির্দিষ্ট তারিখে বাকি টাকা পরিশোধ ও কয়েন নিতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। খোঁজ নেই দালাল বা বিক্রেতার। এরপর বাধ্য হয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হন ক্রেতা। প্রতারিত হওয়া এক ক্রেতা জানান, কয়েন বিক্রির কথা বলে আমাকে নিয়ে গেছে। তখন আমার কাছে বিক্রির কথা বলে স্ট্যাম্প করে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছে। এই ভণ্ড-প্রতারকরা এমন পরিবেশ তৈরি করে যে, মানুষের তখন আর বিবেক-বুদ্ধি কাজ করে না।
প্রতারণার ধরন প্রসঙ্গে ডিসি ডিবি মশিউর রহমান জানান, লোভী ভিকটিমকে ওই টাকা ইনভেস্ট করার পর মুহূর্ত থেকেই পলাতক হয় প্রতারক চক্রটি। এই চক্রটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ মামলাটি উত্তরা পশ্চিম করা হয়। এই মামলার ছায়া তদন্ত করতে গিয়েই এদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিসি ডিবি জানান, প্রায় ১০ বছর যাবত রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে কয়েনের পেছনে ছুটে প্রতারিত হয়। ভিটেমাটি বিক্রি করা মৌলভীবাজারের সৈয়দ মুস্তাকিন আলি ওরফে অহিদুজ্জামান নিজেই কয়েন প্রতারণার ব্যবসায় নেমে পড়ে। মতিন মোল্লা ওরফে মোল্লা আতিকের কাছ থেকে একই প্রক্রিয়ায় প্রতারণার কৌশল শেখা সাইদুল ইসলাম জিহাদ ওরফে রাজার সঙ্গে সৈয়দ মুস্তাকিন আলি ওরফে অহিদুজ্জামানের পরিচয় হয়। প্রথমত, সাইফুল ইসলাম ওরফে স্বপন কমলাপুর এলাকার রনির মাধ্যমে ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে প্রতারক চক্র প্রথমে তাদের বাসায় এবং পরবর্তীতে একবার রেডিসন হোটেলে, দুবার লা মেরিডিয়ান হোটেল এবং পরবর্তীতে দুবার উত্তরাস্থ লেকভিউ হোটেলে মিটিং করে প্রতারণার বিভিন্ন ধাপ সম্পন্ন করে। এ প্রতারক চক্রটি প্রথমত, তিনটা গ্রুপে ভাগ হয়ে কার্য সম্পন্ন করে প্রথম গ্রপে থাকে মিডিয়াম্যান যেটা নেতৃত্ব দেয় সাইদুল ইসলাম ওরফে রাজা, দ্বিতীয় গ্রুপে থাকে মালের মালিক সাইফুল ইসলাম ওরফে শঙ্কর মালে ওরফে স্বপন এবং মতিন মোল্লা ওরফে মোল্লা আতিক। তৃতীয় গ্রুপে থাকে দুজন বিদেশী বায়ার এবং একজন বায়ারের প্রতিনিধি। বিদেশী বায়ার দুজনকে ম্যানেজ করে সৈয়দ মুসতাকিন ওরফে অহিদুজ্জামান। সিলেটে বাড়ি, লন্ডন প্রবাসী আখলাক এবং সাইমন বিদেশী বায়ার সাজে এবং তাদের প্রতিনিধি এবং কেমিস্ট সাজে সৈয়দ মুস্তাকিন আলি ওরফে অহিদুজ্জামান। মালের মালিক পক্ষ ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে প্রথম দিকে একাত্ম হয়ে যায়। বুঝাতে থাকে এত টাকার মালামাল হ্যান্ডেলিং করার ক্ষমতা তাদের নেই। মালের মালিক পক্ষ ২ কোটি টাকায় দুর্লভ কয়েন ভিকটিম পক্ষকে দিতে রাজি হয়, ভিকটিম পক্ষ যা বিদেশী বায়ারের কাছে বিক্রি করে ৫ কোটি টাকা পাবে। আবহ তৈরি করার জন্য প্রতারকরা বিভিন্ন ধনকুবেরদের নাম্বার সেভ করে ফোনে লক্ষ- কোটি কোটি টাকার কথোপকথন করতে থাকে। বায়ারের প্রতিনিধি এবং কেমিস্ট অহিদুজ্জামান ওরফে সৈয়দ মুস্তাকিন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং কেমিক্যালস, কার্বন, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ইত্যাদি দিয়ে কয়েনের রেডিয়েশান এবং তার গুণগতমান ভিকটিমের সামনে পরীক্ষা করে মতামত দেয়। এই ভুয়া যন্ত্রটি সে মিটফোর্ড এলাকা থেকে কেনে, যেটি মূলত কান পরীক্ষা করার ডাক্তারি যন্ত্র। এই যন্ত্রটি কয়েনর ওপর ধরলে হালকা রঙিন আভা পাওয়া যায়। কেমিক্যালগুলো মূলত বিভিন্ন শ্যাম্পু, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি। বায়ার এবং বায়ারের প্রতিনিধি পরবর্তী দিনে ভিকটিমকে টাকা দেবে বলে আশ্বস্ত করে পলাতক হয়। একই প্রক্রিয়ায় চক্রটি একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দুর্লভ প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ম্যাগনেটিক কয়েন পাওয়া যায় এমন গুজবই মূলত এই প্রতারণার ক্ষেত্র তৈরি করে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ জানান, এ রকম প্রতারক চক্র বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। এমন অস্বাভাবিক কোন প্রলোভন থেকে সবাইকে সাবধান হওয়া জরুরী।