
সমুদ্র হক ॥ জলজ উদ্ভিদের এই ফল জনপ্রিয়। শিকড় থাকে জলাশয়ে পানির নিচে কাদামাটিতে। পানির ওপরে ভাসে পাতা। এই লতাপাতা মূল কান্ডের ওপরে জড়িয়ে রাখে গাঢ় সবুজের মোড়কে কিছুটা কালচে ও লালচে ত্রিভূজ আকৃতির রসালো সুমিষ্ট ফল। ধীর প্রবাহমান স্রোতের পানিতে জন্মে। পরিচিতি-পানিফল। অঞ্চল বিশেষে নাম সেঙ্গরা বা সিঙ্গরা। দেখতে হোটেল রেস্তরাঁয় বানানো সিঙ্গরার মতো হওয়ায় এই নাম। প্রতিটি এলাকায় রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে সুস্বাদের পানিফল।
শীত বসন্ত পাড়ি দিয়ে গ্রীষ্মের কিছুটা সময় থাকবে। পানিফলের জন্ম বৃত্তান্ত বেশ মজার। শস্য ও অন্যান্য ফলফলাদি সমতল অসমতল মাটির গাছে ধরে। এই ফলের গাছ থাকে পানির নিচে। জলাশয়ে খালবিলে সেঙ্গরা বা সিঙ্গারার চাষ হয়। চারা তৈরি হয় পাকাপোক্ত ফল থেকে। এই চারা বিশেষ কৌশলে রোপণ করতে হয় জলাশয়ের শয্যায় (নিচে কাদামাটিতে)। এই পানিফল চাষ নিয়ে সুষ্ঠু গবেষণা পরিকল্পনা কোনটিই হয়নি। গ্রামের মানুষের ব্যক্তি আগ্রহে এবং কৃষক আপনমনেই সেঙ্গরা ফলায়।
প্রায় তিন হাজার বছর আগে পানিফলের চাষ শুরু হয় চীন দেশে। বিজ্ঞানীরা তাই বলছেন। বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদের ইংরেজী নাম ওয়াটার চেস্টনাট। স্থানভেদে ইংরেজী নামের ব্যত্যয় ঘটে। যেমন ওয়াটার কালট্রপ, বাফেলো নাট, ডেভিলপড ইত্যাদি। ডেভিলপড নাম এসেছে চীন থেকে। চীনারা মনে পানির ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোন ডেভিল। অনেকে পানিফলকে পানির বাদাম বলে। তবে ফলের শাসে বা খোসার ভেতরে বাদামের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। শক্ত সাদা। তাত্ত্বিক বা বিজ্ঞান নাম ট্র্যাপা বাইস্পাইনাসো যা অনাগ্রাসো প্রজাতির পরিবারভুক্ত। ত্রিকোন এই ফলের দুটি কাঁটা থাকে। পানিফল সাধারণত কাঁচা অবস্থায় চিবিয়ে খাওয়া হয়। আকারে বড় পানিফল সিদ্ধ করে তরকারি হিসেবে রান্না করা যায়। যে কারণে পানিফলের আরেক পরিচিতি সবজি। চীনের খাদ্য তালিকায় পানিফল নানাভাবে খাওয়া হয়। তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে রান্না সুস্বাদের করা হয়। ফলের শ্বাস শুকিয়ে আটা বানিয়ে রুটি পিঠা বানানো হয়। হালে ঢাকা ও বড় শহরের তারকাখচিত হোটেলে পানিফলের আটায় রান্নার নতুন রেসিপি তৈরি হয়েছে। সবুজ কালচে ও লালের মিশ্রণের এই ফলের পুষ্টি ও ভেষজগুণ অনেক।
মে মাস থেকে পানিফলের চাষ শুরু হয়। জুন মাসে বৃষ্টি হলে জলাশয় ভরে গেলে চারা রোপণ করা হয়। পূর্বের বড় পানিফল প্রক্রিয়াজাত করে রেখে দিলে ত্রিকোণের দুই কাঁটার সঙ্গে চারা জন্মে। এই চারা রোপিত হয় জলাশয়ে। পানির উপরিভাগে এমনভাবে রাখতে হয় যাতে দ্রুত নিচে কাদায় পৌঁছে। জন্মে শিকড়। তারপর পানির ভেতর দিয়ে শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটে। ওপর থেকে দেখা যায় না। ডুব দিলে বোঝা যায় নরম লতা জড়িয়ে ধরছে। পানির ওপরে মোটা ও নরম পাতাগুলো গোলাকার হয়ে ভাসে। পাতা লম্বা ৮ সেন্টিমিটার। চারধারে খাঁজকাটা চওড়া ৬ সেন্টিমিটার। পত্রফলক মাংশালো পুরু ও তেলতেলে। পানিফলের গাছ পানির নিচে ৫ মিটার গভীর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
বগুড়ার কৃষি বিভাগ জানায়, আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত চারা রোপিত হয়। আড়াই মাসের মধ্যে ফল তোলা যায়। ফলের কোন বীজ নেই। মৌসুম শেষে পরিপক্ক হলে চারা গজায়। বগুড়া সদরের কয়েকটি এলাকা,
গাবতলি শিবগঞ্জ সোনাতলা এলাকায় সেঙ্গরার চাষ হচ্ছে। গাবতলির খইলশাকুড়ি বিলে সেঙ্গরার চাষ করছেন বেলাল হোসেন। জানালেন এই বড় বিলে তার সঙ্গে আরও সাতজন আছেন। চারা রোপণের পর কিছু সার ও অল্প কীটনাশক ছিটাতে হয়। বগুড়া সদরের সাবগ্রাম এলাকার জলাশয়ে চাষ করছেন আব্দুস সামাদ। জানালেন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পানিফল তুলে ভ্যানগাড়িতে করে নিয়ে যান বগুড়ার চেলোপাড়া চাষীবাজারে। অন্তত পাঁচমাস পানিফল তোলা যায়। কৃষি বিভাগ জানায় প্রতিবিঘা জলাশয়ে গড়ে ২ মেট্রিকটন পানিফল মেলে। হেক্টরপ্রতি ফলন ১৮ থেকে ২০ মেঃ টন। প্রতি বিঘায় খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। মৌসুমে প্রতিমণ পানিফল বিক্রি হয় এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। খুচরা প্রতি কেজি ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা।
খাদ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানিফলে শর্করা, আঁশ রাইবোফ্লোভিন ছাড়াও ভিটামিন বি, ভিটামিন বি-২, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালশিয়াম, আয়রন পরিমাণমতো আছে। রসালো পানিফলের স্বাদ আলাদা। ভেতরের সাদা অংশ ছাড়াও পানিফলের খোসায় তরকারি রান্না করা যায়। এর ভেষজ গুণাগুণে এ্যালার্জি তলপেটে ব্যথা উদারাময় রোগে অনেক উপকারী। দেশের প্রতিটি স্থানে পানিফলের চাষ হচ্ছে। সূত্র জানায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয় দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরার দেবহাটা ও উত্তরাঞ্চলের বগুড়া ও নওগাঁয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্নস্থানে। পানিফল বা সেঙ্গরার স্বাদ বলতে কথা।