ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পানসি গয়না ডিঙ্গি জড়িয়ে আছে বাঙালী সংস্কৃতিতে

প্রকাশিত: ২১:৫১, ২৩ আগস্ট ২০২১

পানসি গয়না ডিঙ্গি জড়িয়ে আছে বাঙালী সংস্কৃতিতে

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর ঋতু বৈচিত্র্যের বর্ষাকাল খেই হারিয়ে এখন সময়মতো আসেও না, যায়ও না। নদীমাতৃক দেশে জলযান নৌকার কারিগররাও হেলে দুলে নৌকা বানায়। গত ক’বছরের ঋতুর হাবভাব দেখে তারা বুঝে নিয়েছে নৌকা তৈরি অনেকটা সময় ধরে চলবে। আষাঢ়ের আগে বর্ষা আসতে পারে। আষাঢ়-শ্রাবণ তো বর্ষার কাল। শ্রাবণের পরও অনেকটা সময় বর্ষার রেশ থাকে। বন্যার মতিগতিরও ঠিক নেই। বর্ষার বন্যা, পাহাড়ি ঢলের বন্যা, অতিবৃষ্টির বন্যা। আকস্মিক বন্যা। পানি বিশেষজ্ঞদের দেয়া বন্যার একটা নাম ফ্লাশ ফ্লাড। বর্ষা হোক, বাদল দিন হোক, শ্রাবণ মেঘের দিন হোক, ঢল আসুক নদী ভরে উঠুক, চরগ্রাম ডুবে যাক, ভাঙনে জনবসতি হারিয়ে যাক নৌকা লাগবেই। নদী তীর চরগ্রামের মানুষের নৌকা ছাড়া গতি নেই। দুর্যোগে মানুষ বাঁচাতে নৌকা সঙ্গী হয়ে আসে। নৌকা বাঙালীর সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। বগুড়ার যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি এলাকায় এই সময়ে নৌকা বানানোর হিড়িক পড়েছে। বৃষ্টির কারণে অনেক কারিগর বৃষ্টিরোধক কাপড় টাঙ্গিয়ে নৌকা বানাচ্ছেন। নান্দিয়ারপাড়া গ্রামের সাজু মিস্ত্রি জানালেন, নৌকার অনেক ধরন আছে। সাধারণ নৌকা ১২ থেকে ১৪ মিটার লম্বা। চওড়া মধ্যে ৩ থেকে ৬ ফুট। গলুইয়ের কাছে কমে যায়। নৌকার সাইজ ও মান অনুযায়ী দাম। ১১ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা দামেরও আছে। যার যা পছন্দ তাই কেনে। কেউ অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়। নৌকার কয়েকটি অংশ। খোল, পাটা, ছই, ছাউনি, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি (গুন), মাস্তুল, নোঙর, গলাই বৈঠা, লগি, গুন। নদী তীর ও চরগ্রামের প্রত্যেক গৃহস্থের নৌকা আছে। বর্ষাকালে কৃষক অন্যের নৌকা ধার নিয়ে জলপথ পাড়ি দেয়। নদী তীরের প্রতিটি এলাকায় আছে নৌকার কারিগর। ধারাবর্ষা চরের কাছে নৌকার হাট বসে। সেখানে সারিয়াকান্দি ছাড়াও পাশের জামালপুর জেলার বিভিন্ন এলাকার কারিগররা নৌকা নিয়ে আসে। বর্তমানে সেদিনের সেই খেয়াঘাট নেই। খেয়া পারাপার নেই। তবে পারাপার আছে। এক চর থেকে আরেক চরে যেতে নৌকা একমাত্র বাহন। প্রতিটি ঘাটে মাঝিমাল্লারা নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। নিকট অতীতে শুধু লগি বৈঠার নৌকা ছিল। এখন শ্যালো ইঞ্জিনে নৌকা দ্রুত চলাচল করে। তবে পাড়ে ভিড়াতে লগি বৈঠা লাগে। পাড়ের কাছে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে লগি ধরে বৈঠায় টেনে নিতে হয়। সারিয়াকান্দির রফিকুল ইসলাম বললেন, নৌকার তলা তৈরিতে দরকার আম ও জিগা গাছের কাঠ। দুই ধারে থাকে ইউক্যালিপটাস কাঠ। অনেকে আরও উন্নত কাঠে নৌকা বানায়। তারা উপকূলীয় এলাকা থেকে সাম্পান তৈরির কাঠ নিয়ে আসে। কেউ আনে বার্মাটেক কাঠ। সব ধরনের গাছের কাঠে নৌকা তৈরি হয় না। নৌকা মজবুত করে বানাতে উন্নতমানের কাঠের দরকার। নদী তীরের এলাকায় বর্তমানে প্রায় ভর মৌসুম নৌকা তৈরি হয়। বর্ষার আগে ছাতা মেরামতের মতো অনেকে নৌকা মেরামত করে। নৌকার পাটাতনে ছিদ্র থাকলে মেরামতের দরকার। তা না হলে ছিদ্র বড় হয়ে পারাপারের সময় পানি ওঠে। মাঝি নগেন বললেন, পাটাতন দিয়ে নানা কারণে পানি উঠতে পারে। এজন্য টিনের থালা রাখতে হয়। মাঝি নৌকা বায় সঙ্গের লোক থালা দিয়ে পানি ছেচে নদীতে ফেলে। তবে বর্তমানের শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকাগুলো অধিক মজবুত করেই বানানো হয়। বর্ষা মৌসুমের আগে গৃহস্থরা নৌকায় গাব দিয়ে ঘষে। আলকাতরা লাগায়। এভাবে মোটরগাড়ির মতো নৌকাকে সচল রাখা হয়। দেশে এখনও নানা ধরনের নৌকা তৈরি হয়। পানসি নৌকা, কোষা নৌকা, বজরা নৌকা, ছিপ নৌকা, গয়না নৌকা, ডিঙ্গি, পাতাম সাম্পান ইত্যাদি। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের নৌকার প্রচলন। উত্তরাঞ্চলে ডিঙ্গি নৌকা পানসি নৌকা ও সাধারণ নৌকা বেশি। পণ্য বোঝাই বড় নৌকা স্রোতের প্রতিকূলে বাইতে প্রয়োজন হয় গুনের। গুন এক ধরনের রশি। মাঝির সহকারী দুই-তিনজন পালের শক্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নদীর তীর ধরে টেনে নিয়ে যায় নৌকা। উপকূলীয় এলাকার নৌকার ধরন বেশি। একটা সময় ব্যবসায়ীদের বজরা নৌকা ও ময়ূরপক্সিক্ষ নৌকা ছিল। এখনও উপকূলীয় এলাকায় ধনী ব্যবসায়ীরা নৌকায় বাড়িঘর বানিয়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যায়। এর সঙ্গে মাছ ধরার নৌকা আছে। পরিচিতি খেয়াজালের নৌকা। গভীর সমুদ্রের মাছ ধরার নৌকা কখনও সাম্পান কখনও ট্রলার। আরেক ধরনের নৌকা আছে যাকে বলা হয় বেদের নৌকা। অতীতে বেদের নৌকার বহর ছিল। বেদেরা নৌকায় বাড়িঘর বানিয়ে সংসার পেতে এক স্থান থেকে ছুটতো আরেক স্থানে। বেদের নৌকা কোন ঘাটে নোঙর করে আশপাশের গ্রামে সাপের খেলা দেখিয়ে কথিত শিকড়বাকর বেচতো। বেদের বহর ছিল সংস্কৃতির একটি অংশ। সেই অধ্যায় হারিয়ে গেছে। এখন কালেভদ্রে বেদের বহর দেখা যায়। আরেক ধরনের নৌকা বাঙালীর সংস্কৃতির বড় অংশজুড়ে আছে তা হলো বাইচের নৌকা। অর্থাৎ নৌকার দৌড় প্রতিযোগিতা। এই নৌকা লম্বায় দেড় শ’ থেকে দুই শ’ ফুট। নদী তীরে বর্ষা মৌসুমে নোকাবাইচ একটা বড় উৎসব। বাইচের নৌকা প্রতিযোগিতা বাঙালীর চিরন্তন সত্ত্বা সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। এই নৌকা প্রমাণ করে বাঙালী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জাতি।

আরো পড়ুন  

×