ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথম ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদন

প্রকাশিত: ০০:০১, ২৪ এপ্রিল ২০২১

কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথম ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদন

স্টাফ রিপোর্টার,ময়মনসিংহ ॥ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআইয়ের আরও একটি সাফল্যের খবর। করোনাকালে এবার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো হারিয়ে যাওয়া ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে এই সাফল্য অর্জন করার দাবি করেছে বিএফআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা। ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহের স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রে টানা দু’বছর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা এই সাফল্য অর্জন করেন। গবেষক দলে ছিলেন কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ শাহা আলী, উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ রবিউল আওয়াল। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ স্থানীয় সাংবাদিকদের শুক্রবার সকালে এই সাফল্যের খবর জানান। স্থানীয় সূত্র জানায়, এক সময় দেশের নদ-নদী ও হাওড়, বিলে প্রচুর পরিমাণে ঢেলা মাছ পাওয়া যেত। পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তন, অতিআহরণ ও জলাশয় সংকোচনের কারণে ঢেলা মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে মাছটি বিলুপ্তির তালিকায় চলে আসে এবং ঢেলা মাছ এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য ও উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রি হয়। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করায় ঢেলা মাছকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং মাঠ পর্যায়ে চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় ঢেলা মাছে প্রচুর খনিজ পদার্থ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেলা মাছে ভিটামিন এ রয়েছে ৯৩৭ আই ইউ, ক্যালসিয়াম ১২৬০ মি.গ্রাম এবং জিঙ্ক ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশি। ভিটামিন এ শিশুদের রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে, ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা করোনাকালীন খুবই জরুরী। ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন উৎস্য থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে তা নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়। প্রতিপালনকালে এর খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পরীক্ষা করা হয় এবং সে অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। এর বাইরে বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। হিস্টোলজি পরীক্ষাকালে দেখা যায়, ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম মে-জুন মাস হলেও এপ্রিল মাসের শেষদিকে এর প্রজনন কাল শুরু হয়। এর ডিম ধারণ ক্ষমতা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ৭০০-৮০০টি। গবেষণাকালে আরও দেখা যায়, ১টি স্ত্রী ঢেলা মাছ প্রায় ৬-৮ গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ ঢেলা মাছ আকারে অপেক্ষকৃত ছোট (৪-৫ গ্রাম) হয়। প্রকৃতিতে স্ত্রী ঢেলা মাছের চেয়ে পুরুষ ঢেলা অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া যায়। বিভিন্ন উৎস্য থেকে ঢেলা মাছ সংগ্রহকালে দেখা গেছে, প্রকৃতিতে স্ত্রী ও পুরুষ ঢেলাপ্রাপ্তির অনুপাত হচ্ছে ৪ দশমিক ১ অর্থাৎ ৪টি স্ত্রী ঢেলার সঙ্গে মাত্র ১টি পুরুষ ঢেলা থাকে। সূত্র আরও জানায়, গবেষণায় ১০ জোড়া ঢেলা মাছকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা পর ঢেলা মাছ ডিম ছাড়ে এবং ২২ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু উৎপাদিত হয়। এ সময় ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত ঢেলার পোনা বর্তমানে ইনস্টিটিউটের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এর বিজ্ঞানীরা। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, পুষ্টিসমৃদ্ধ ঢেলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে এর পোনা উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সহজতর হবে এবং ঢেলা মাছকে সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এর আগে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বৈরালিসহ ইতোমধ্যে ২৪টি দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। ফলে এসব মাছের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সাম্প্রতিকালে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যান মতে ২০০৮-২০০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মে.টন। পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ সালে হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মে. টন অর্থাৎ গত ১২ বছরে চাষে দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৪ গুণ। ইনস্টিটিউটে বর্তমানে পিয়ালি, কাজলী, বাতাসি, কাকিলা, রাণী ও গাং টেংরাসহ আরও ১০টি মাছ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব ব্যাপারে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বিপন্ন প্রজাতির সকল দেশীয় মাছকে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে ইনস্টিটিউটে সাম্প্রতিককালে ছোটমাছের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে ১টি লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণসহ গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে গৌরবজনক ‘একুশে পদক’ লাভ করে।

আরো পড়ুন  

×