ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

ঐতিহ্যবাহী ডলইন

ধান ভানা ও পিঠা তৈরির দেশীয় যন্ত্র আজ শুধুই স্মৃতি

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ২৫ জানুয়ারি ২০২১

ধান ভানা ও পিঠা তৈরির দেশীয় যন্ত্র আজ শুধুই স্মৃতি

এইচএম এরশাদ ॥ যান্ত্রিক সভ্যতার ভিড়ে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী ডলইন। এক যুগ আগেও জেলার অধিকাংশ গ্রামের প্রায় প্রতিটি গৃহস্থালি বাড়িতেই ছিল এই ডলইন। এই যাঁতা তথা ডলইন ঘুরিয়ে ধান ভানার অভ্যাসও ছিল মেয়েদের। কালের বিবর্তনে ডলইনের সংখ্যা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। কালেভদ্রেও আর দুই একটা চোখে পড়ে না ধান ভানার যন্ত্র বাঁশ ও কাঠ দ্বারা তৈরি এই ডলইন। আগেকার দিনে যখন রাইস মিল বা ফ্লাওয়ার মিল ছিল না। তখন গৃহস্থবাড়ির মহিলাদের ধান ভানার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই ডলইন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে আজ ঐতিহ্যবাহী ডলইন বিলীন হয়ে গেছে। আগে বাড়িতে মেহমান এলে পিঠা বানানোর জন্য ডলইনে বিন্নিধানের চাল তৈরি করে গভীর রাত পর্যন্ত ভাতপিঠা বানানো হতো। ভাতপিঠা অতিথিদের আপ্যায়ন করার মজাই ছিল আলাদা। এখন বিন্নিধান ও চিকন চাল তৈরির মূল উপকরণ কয়েকটি গ্রামে খুঁজলেও একটা ডলইন পাওয়া যায় না। কলে (রাইস মিল) পেষা ধানের চাল দিয়েই তৈরি করতে হচ্ছে সেই ভাত বা আতিক্যা পিঠা। এখন আর ঝামেলা নেই। বাজারে পাওয়া যায় বিন্নিধানের উন্নত চাল। আগে নতুন ধান উঠলে ডলইনে ধান ভেঙ্গে চাল এবং সেই চাল থেকে ঢেঁকিতে গুঁড়ি তৈরি করে গ্রামের ঘরে ঘরে ভাপাপিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। মোটা জাতের আমন ধান ডলইনে পিষে চাল তৈরি ও ভাতপিঠা দুটোরই মজা আলাদা ছিল। বিন্নিধানের আতিক্যা পিঠা খেতে খুবই স্বাদ। এই মজা যেন দাঁতে লেগেই থাকত কিছুক্ষণ। গৃহস্থের ঘরে ঘরে সকালের নাস্তা হিসেবে বিন্নি ভাতই চলতো লাগাতার কয়েক মাস। মোটা জাতের আমন চালের ভাপাপিঠা ও বিন্নিধানের চালের ভাতপিঠা বর্তমানে নতুন প্রজন্মদের জন্য শখের বস্তুতে পরিণত হয়েছে বলা চলে। লাল-কালো বিন্নিধানের চাষও কমে গেছে সর্বত্র। বিন্নিভাত ও বিন্নিধানের চিড়া আলাদা মজা। গ্রাম থেকে ডলইন হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এখন আর সে দৃশ্য চোখে পড়ে না। আগেকার দিনে এত বেশি রাইস মিলও ছিল না। বেশিরভাগ গৃহস্থালি বাড়ির ডলইনেই ধান ভানা হতো। নববধূও হাতের মেহেদি শুকানোর আগেই যাঁতার কাঠ ধরে ধান ভানা শুরু করতো। এক সময় গ্রামের দরিদ্র ঘরের বিধবা ও দুস্থ মহিলাদের উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ার ছিল এই ডলইন। চাষাবাদকারী ঘরে ঘরে গরিব মহিলারা ডলইনে শ্রম দিয়ে চাল ও টাকা নিয়ে তাদের সংসার চালাতেন। বর্তমানে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বিদ্যুতের বিস্তার ঘটায় প্রতিটি গ্রামেই গড়ে উঠেছে ছোটখাটো রাইস মিল। তাই বর্তমানে ডলইনে চাল তৈরিকারী মহিলারা বাধ্য হয়ে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই ডলইনের আজ অস্তিত্বসঙ্কটে। তবে এখনও কোন কোন গ্রামে দু’একটি বাড়িতে ডলইনের দেখা মেলে। তাও কিন্তু অচল। স্মৃতিস্বরূপ রাখা হয়েছে। ডলইনে ছাঁটাইকৃত চাল ধবধবে সাদা না হলেও ভাত ছিল আলাদা মজা। বর্তমানে চাল ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতচালিত মেশিনে ধান ছাঁটাই করার পর ইউরিয়া সার দিয়ে পালিশ করে ওইসব চাল চকচকে করে বাজারজাত করছে বলে প্রচার রয়েছে। টেকনাফ হোয়াইক্যং এলাকার একজন মহিলা জনকণ্ঠকে জানান, যখন এলাকায় বিদ্যুত ছিল না, তখন গৃহস্থালি মেয়েদের ডলইনই একমাত্র ভরসা ছিল। এতে চাল ছাঁটাই করতে তখন তাদের মনে অনেকটা আনন্দও লাগত। এক সময়ের গ্রাম বাংলার ধান ভানার প্রধান যন্ত্র ছিল ডলইন। ডলইন প্রধানত ধান থেকে তুষ ছাড়িয়ে চাল বানানো কাঠের তৈরি যন্ত্রবিশেষ। মাটি থেকে প্রায় চারফুট উচ্চতা দুই ভাগে বিভক্ত এই যন্ত্রের উপরিভাগের অংশ ছিল ধানের আঁড়ির মতো। ওই অংশে দেয়া হতো ধান। নিচের অংশ ধানের ডোলের মতো হলেও সেখানে মাটিভর্তি এবং উপরি অংশে থাকত কাঠের বিট। উপরের অংশের নিচের ভাগেও থাকত ওই রকমের বিট। উপরের অংশে দুই পাশে ছিদ্রযুক্ত দুইটি হাতল থাকত। ডলইন ঘুরানোর সময় দুই অংশের বিটে ঘষা খেয়ে ধান থেকে চাল বেরিয়ে পড়ত মাটিতে। দুটি কাঠের চারটি খুঁটিতে দাঁড়ানো এই ডলইন বছরের পর বছর ধান ভানার কাজে ব্যবহার হতো। গৃহস্থের বাড়িতে পৃথক ডলইনঘরও থাকত। কারও কারও বারান্দায় থাকত ডলইনঘর। কালের ব্যবধানে এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ডলইনের ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চলে মাঝে মাঝে দু’একটা চোখে পড়ে। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ডলইনের অস্তিত্ব আজ বিলীন।
×