
ওয়াজেদ হীরা ॥ ফসল পঞ্জিকায় শীতকালীন সময়টাতে রবি মৌসুমের মেয়াদকাল ধরা হয়। আর সেই রবি মৌসুমের ফসল আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। শীতকালীন নানা ধরনের সবজিসহ চলতি মৌসুমের আলু, পেঁয়াজ, ডাল, তেল জাতীয় বিভিন্ন রবি ফসল নিয়ে মাঠপর্যায়ে ব্যস্ততা দেখা গেছে। এছাড়াও চলতি বছর বিভিন্ন দুর্যোগে আউশ আমন ধানের কিছু ক্ষতি হওয়ায় রবি ফসলে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারও। বিগত বছরের চেয়ে এ বছর প্রায় সব ধরনের রবি ফসলে বাড়ছে আবাদি জমিও।
কৃষি বিভাগের হিসেবে ১৬ অক্টোবর থেকে রবি মৌসুম ধরা হয়ে থাকে। কৃষকরা নানা ধরনের রবি মৌসুমের ফসল উৎপাদনের জন্য জমি তৈরি করাসহ বীজ রোপণ করেন। পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করেন। যদিও ইতোমধ্যেই বাজারে আগাম শীতের সবজি পাওয়া যাচ্ছে একটু বেশি মূল্যে। আগাম শীতের ফসল পাওয়া গেলেও রবি মৌসুমের ফসল চাষাবাদ হচ্ছে এখন। এবার সময় মতো রবি ফসল চাষ শুরু করা যায়নি দেশের অনেক জেলায়ই।
সাম্প্রতিক সময়ের সাগরে নিম্নচাপের কারণে জমিতে জোঁ না আসায় অনেক কৃষকই সময়মতো রবি ফসল চাষ শুরু করতে পারেনি। তবে আবহাওয়া রৌদ ঝলমলে হওয়ায় ইতোমধ্যেই মাঠে মাঠে ছুটছেন কৃষকরা। অক্টোবর মাসের শেষের দিক শুরু হয় এই ফসল আবাদ যা এখনও চলছে। অনেক জেলায় কৃষকদের বোনা বিভিন্ন ফসল এখন যতœ নিচ্ছেন।
করোনাভাইরাস মহামারী ও চলতি বছরে কয়েক দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার রবি মৌসুমে কয়েকটি ‘পুনর্বাসন কর্মসূচী’ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, কৃষক যাতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে সেজন্য পুনর্বাসন কর্মসূচী নেয়া। আমরা রবি ফসলে ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মসূচী নিয়েছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময় থেকেই মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নানা নির্দেশনা দিচ্ছি। তবে এবার অনেক জেলায় একটু দেরিতে হলেও এখন পরিবেশ বেশ সুন্দর ঝলমলে। কোন অসুবিধা নেই, কৃষকরাও ব্যস্ত এখন রবি ফসল নিয়ে। হয়ত দেরি হওয়ার কারণে ফসলটাও একটু দেরিতে আসবে তবে আবাদের যে লক্ষ্য রয়েছে তাতে কোন সমস্যা হবে না বলেও জানান। মোঃ আসাদুল্লাহ আরও বলেন, যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হতো এখন বাজারে আগাম যে সবজি পাওয়া যাচ্ছে বেশি পাওয়া যেত।
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কৃষকরা জানিয়েছেন, কিছু অঞ্চলে এখন রবি আবাদ জোরেশোরে চলছে। ইতোমধ্যেই মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও যশোর অঞ্চলে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। এটি মৌসুমি পেঁয়াজ হলেও আগেভাবেই বাজারে উঠবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সরেজমিন উইং থেকে জানা গেছে, এ বছর ৫ লাখ ৮২ হাজার ৯৬২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি অবাদের লক্ষ্য রয়েছে যা গত বছর ছিল ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯০০ হেক্টর। সে হিসেবে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে বাড়ছে সবজির আবাদ। সারাদেশে আলু ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৬ হেক্টর আবাদ হচ্ছে যা গত বছর ছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। সে হিসেবে বাড়ছে আলুর আবাদও। এছাড়াও ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৬৪ হেক্টর জমিতে গম আবাদের লক্ষ্য রয়েছে যা গত বছর ছিল ৩ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। এবার ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫৪৭ হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদ হচ্ছে যেখানে গতবার ছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার ৯০০ হেক্টর জমি। মসলা জাতিয় ফসল আবাদ হচ্ছে এ বছর ৬ লাখ ৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। পেঁয়াজ ২ লাখ ১৯ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য রয়েছে। ডাল ৮ লাখ ১ হাজার ৫৬৯ ও তেল ৭ লাখ ৭৬ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমিতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সূত্রমতে, অসময়ে আর বৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অনায়াসেই পূরণ হবে। অনেকক্ষেত্রে ফলনও ভাল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, রবির মধ্যে শীতকালীন সবজি ও ভুট্টা পড়ে। সেটির কোন অসুবিধা হয়নি।
দেশের সর্বত্রই কম বেশি রবি ফসল চাষ হয়ে থাকে। একাধিক জেলার কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় এখন আমন ধান সামনে ঘরে আনার প্রস্তুতি সেই সঙ্গে রবি ফসল কিভাবে ভাল করা যায় তা নিয়েই ব্যস্ততা রয়েছে। গাজীপুরের বরমী এলাকার হুরমুজ উদ্দিন ইতোমধ্যেই বপন করেছেন লাল শাক যা চারাও গজিয়েছে। নিয়মিত তিন আগাছা পরিষ্কার করছেন। শাকগুলো আর নবেম্বরের শেষের দিকে বিক্রি করতে পারবেন বলেও জানান। একই এলকার জুলহাস তিনি আমনে ব্যস্ত থাকায় ফাঁকা জমিতে এখনও কিছু বুনতে পারেননি। তবে জমি প্রস্তুত করেছেন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আজিজুল এবার বাঁধাকপির জন্য নিয়মিত সময় দিচ্ছেন জমিতে। সামনে ভাল ফলনের আশায় কিছু কাঁচামরিচও লাগাবেন তিনি।
রাজশাহী কৃষি অফিস ও কৃষকদের থেকে জানা গেছে, অতিবর্ষণ ও বন্যার প্রভাব পড়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে রবি ফসল আবাদে। বানের পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষক নেমে পড়েছে বানের জলে আসা পলি মাটিতে রবি শষ্য আবাদে। বরেন্দ্র অঞ্চলে কোথাও কোথাও উঁচু জমিতে আগাম আবাদ হওয়া পেঁয়াজ (মুড়ি কাটা) রসুন, মরিচ, তিল, আদা, চীনাবাদাম, কলাই চাষাবাদ হচ্ছে। আলু, টমেটোর আবাদ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামছুল হক জানান, এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ডাল জাতীয় কুড়ি হাজার হেক্টরে। পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা আঠারো হাজার হেক্টর ধরা হলেও আবাদ হয়েছে আরও এক হাজার হেক্টর বেশি জমিতে। আর কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার রবি শস্যেও আবাদ ভাল হওয়ার প্রত্যাশা কৃষি বিভাগের।
দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও টানা বৃষ্টির কারণে বগুড়ায় রবি মৌসুমি ফসল চাষের লক্ষ্যমাত্রা শুরুর দিকে উল্লেখযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। তবে এখন শুরু হয়েছে চলতি নবেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লক্ষ্যমাত্রার অনেকটাই পূরণ হয়ে যাবে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। বগুড়া কৃষি অঞ্চল অফিস সূত্রে জানা গেছে, রবি শস্যের মধ্যে এবার বগুড়া অঞ্চলে ১০,৩৮০ হেক্টরে মরিচ, ৫৮,৮৮০ হেক্টরে পেঁয়াজ, ১৪,৯৫৭ হেক্টরে রসুন, ২২,৪২৮ হেক্টরে ভুট্টা, ৭,৬২০ হেক্টরে চীনাবাদাম, ১,২০,৪১৫ হেক্টরে সরিষা, ২২২ হেক্টরে তিল, ১,১৬,০২০ হেক্টরে গোল আলু, ১,৭৮৫ মিষ্টি আলু, ১৭৭ হেক্টরে কেশর আলু, ২১,৭৪৫ হেক্টরে খেসারি, ২০,৮৩৬ হেক্টরে মসুর, ১৬০ হেক্টরে মুগ, ১,৫৫৬ হেক্টরে মোটর, ৪১,০৬৫ হেক্টরে গম, ১,১০৮ হেক্টরে ধনিয়া, ৮৪৭ হেক্টরে কালোজিরা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে বরিশালেও বিলম্ব হয়েছে রবি ফসল আবাদ। কয়েকদিন আগে নিম্নচাপের কারণে প্রবল বর্ষণে আরও বিলম্ব হয়। প্রচুর বৃষ্টি ও ঝড়ে রোপা আমন বিনষ্ট হলেও কৃষকরা সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রবি ফসল করবেন বলে প্রত্যাশা বরিশাল কৃষি বিভাগের। রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টরে গম, ১০ হাজার হেক্টরে ভুট্টা, ১০ হাজার হেক্টরে গোল আলু, সাড়ে ১২ হাজার হেক্টরে মিষ্টি আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। শীতকালীন মুগ এবং সয়াবিন, সরিষা, তিল ও তিসি ছাড়াও আরও একাধিক শীতকালীন ফসল আবাদের প্রস্তুতি নিয়ে একটু একটু করে কাজ শুরু করেছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা। ভাঁটি এলাকা হওয়ায় এ অঞ্চলে রবি মৌসুম একটু বিলম্বেই শুরু হয় এবার আশি^নের প্রবল বর্ষণের প্লাবণে দক্ষিণাঞ্চলে রবি আবাদ আরও কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে।
বাজারে আগাম শীতের সবজিতে ভরপুর ॥ ইতোমধ্যেই বাজারে আগাম সবজিতে ভরপুর থাকলেও সবজির দাম কমছে না। রাজধানীর বাজারে কোন সবজি ৫০ টাকা কেজির নিচে পাওয়া দুষ্কর। বাজারে আগাম শিম বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকা কেজি। এছাড়াও লাউ, করলা, বরবটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি সবই মিলছে। রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে এসব আগাম সবজি। বিক্রেতাদের মতে, পাইকারি বাজারেই এসব আগাম সবজির দাম বেশি। এবার বন্যার কারণে সবজির দাম বেশি হওয়ায় দাম কমছে না। তবে পুরো শীতের সবজি বাজারে এলে দাম কিছুটা কমে যাবে। যা এখনও মাস খানেক লাগবে বলে মনে করছেন একাধিক সবজি বিক্রেতারা।
রয়েছে সরকারী সহযোগিতাও ॥ বন্যার পর কৃষকরা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাপক উদ্যোগ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনায় শাকসবজি চাষের জন্য প্রায় ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৫২ হাজার কৃষকদের লালশাক, ডাটাশাক, বরবটি, শিম, শশা, লাউবীজ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। যে সব এলাকায় আমন চাষাবাদ সম্ভব হয়নি সেসব এলাকার কৃষকদের জন্য মাশকলাই বীজ ও সার বিনামূল্যে দেয়া হয়।