
মোরসালিন মিজান ॥ ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা ভীষণ প্রিয়। রিমঝিম বৃষ্টি নিয়ে চিরকাল কবিতা করেছে বাঙালী। গান করেছে। নাটক সিনেমা-কোথায় নেই বৃষ্টি! আবার এই একই বৃষ্টি যখন ছন্দ ভুলে একঘেয়ে সুরে অবিরাম বেজে যায়, তখন ভয়ঙ্কর এক ছবি সামনে আসে। বন্যা-ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। জলের নিচে তলিয়ে যায় ফসল। পথ-ঘাট। এমনকি বসত ভিটা। মহা দুর্যোগের কবলে পড়ে মানুষ। এখন ঠিক সে সময়টা চলছে। বর্ষা তার রোমাঞ্চ ভুলে রুদ্ররূপটি দেখাচ্ছে। বলা চলে, ভিলেনের ভূমিকায়।
আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষা কাল। এ সময়টি বৃষ্টির। প্রত্যাশা থাকে, গ্রীষ্মের তালপাকা গরমের পর রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে ধরনী শীতল হবে। নতুন প্রাণ পাবে প্রকৃতি গাছপালা। একইভাবে প্রত্যাশা থাকে, বৃষ্টির সুর ছন্দ গান মানুষের জন্য উপভোগ্য হয়ে ওঠবে। আনন্দে মন নেচে উঠবে। হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে দেবে বর্ষা। এমন প্রত্যাশা থেকেই তো কবিগুরু লিখেছিলেন: হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে/শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ/আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে...। কিন্তু সব সময় প্রত্যাশার কথা মনে রাখে না বর্ষা। এবারও মনে রাখেনি। আষাঢ়ের একেবারে শুরু থেকেই প্রবল বর্ষণ। টানা বৃষ্টি। সাধারণত শ্রাবণে এমনটি দেখা যায়। অথচ এবার আষাঢ়েই দেখা গেছে। প্রথম প্রথম, হ্যাঁ, উপভোগই বর্ষাপ্রিয় করেছে বাঙালী। কিন্তু ধরনটা দেখে আশঙ্কাও করেছিল। শ্রাবণে তাহলে কী হবে? বৃষ্টি কি আরও বাড়বে? বন্যা হবে না তো? এবং তাই হলো। ‘মেঘমল্লার সারা দিনমান/বাজে ঝরনার গান...বাজে ঝরনার গান।’ না, গান আকারে আর থাকল না। মিয়া তানসেনের মেঘমল্লার ভুলে বেসুরো গলায় গাইতে শুরু করল। রুদ্ররূপ ধারণ করল বর্ষা। শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলেÑ/পথে তারি সকল বারি দিলে ঢেলে...। সব দেখে মনে হচ্ছে, শ্রাবণের প্রথমভাগেই সকল বারি ঢেলে দিচ্ছে বর্ষা। ফলাফলÑ বন্যা। যে মাটিকে রসালো করতে, উর্বরা করতে বৃষ্টি চাওয়া হয়, সেই বৃষ্টি অতিরিক্ত হওয়ায় তলিয়ে গেছে ফসল। ঘরবাড়িতে জল উঠেছে।
প্রথম পর্যায়ে ২৫ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত অতিবৃষ্টির কবলে পড়ে দেশ। সেইসঙ্গে উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ী ঢল। এর ফলে নদ নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। দেখা দেয় বন্যা। সিলেট সুনামগঞ্জ রংপুর গাইবান্ধা কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট বগুড়া সিরাজগঞ্জ জামালপুর থেকে আসতে থাকে ক্ষয়ক্ষতির খবর। একইরকম খবর আসতে থাকে নেত্রকোনা রাজশাহী মানিকগঞ্জ ফরিদপুর টাঙ্গাইল থেকে। ১৪ জেলা বন্যাকবলিত হয়।
ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক চিত্রও সংগ্রহ করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়গুলো। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গত সোমবার জানিয়েছেন, বন্যায় অন্তত ১১টি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার ২১০ হেক্টর। এর মধ্যে ৪১ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা। মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৪ হাজার। দ্বিতীয় পর্যায়টি ছিল ১১ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে পূর্বের জেলাগুলোসহ মোট ২৬ জেলা বন্যাকবলিত হয়। ক্ষতি হয় প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর জমির ১৩টি ফসল।
আরেকটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ১৭ জেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৮২৭ জন।
এখনও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার লক্ষণ নেই। উল্টো বাইরের জেলাগুলো থেকে বন্যার পানি ঢাকায় ঢুকে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাজধানী শহরে বৃষ্টিও হচ্ছে প্রচুর। মঙ্গলবারে কথাই যদি ধরা যায়, আবহাওয়া অফিস বলছে, এদিন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৪২ মিলিমিটার। সোমবার রাতে শুরু হওয়া বৃষ্টি মঙ্গলবার সারাদিনই কম বেশি অব্যাহত ছিল। ফলে রাজধানীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ঘাট তলিয়ে যায়। কাওরানবাজার বা নিউমার্কেটের মতো ব্যস্ত এলাকা দিয়ে যেন ছোটখাটো নদী বয়ে যেতে দেখা যায়। নিম্নাঞ্চলগুলো আরও আগে প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে ধানম-ির মতো অভিজাত এলাকাতেও। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির কারণে প্রচ- ভুগেছেন ঢাকার কর্মজীবী মানুষ।
পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকা সরকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষও (ওয়াসা) যেন অসহায়। সংস্থাটির পরিচালক (কারিগরি) শহীদ উদ্দিন বলছেন, লম্বা সময় বৃষ্টি হওয়ায় পানি সরে যেতে সময় লাগছে। এখন বন্যার কারণে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতেও পানির উচ্চতা বেড়েছে। এ কারণেও বৃষ্টির পানি নামতে সময় লাগছে।
এখানেই শেষ নয়, অতিরিক্তি বৃষ্টির কারণে বেড়েছে রোগ বালাই। করোনার কাল তো চলছেই। তার ওপরে পানিবাহিত নানা রোগে ভুগছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ জলের অভাব।
মানুষের মতো পশুপাখিও নীড় হারা। শহর ঢাকার কাকগুলোর দিকে তাকানো যায় না। ভিজে একাকার। অসহায় জবুথবু চেহারা যেন বৃষ্টিকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে।
এ অবস্থায় বৃষ্টি নিয়ে লেখা প্রিয় সব গান কবিতা যেন মিথ্যে হতে চলেছে। ‘মেঘ দে ছায়া দে পানি দে রে তুই আল্লাহ’ গেয়ে যে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হতো, এখন সে বৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি বাড়ানোর বৃষ্টি যাক চলে, ফিরে আসুক রিমঝিম বৃষ্টি। মিয়া তানসেনের মতো বাজিয়ে যাক মেঘমল্লার। বর্ষার কাছে আজ এই যেন একমাত্র প্রত্যাশা।