ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

সেবাও পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুলিশের কাজকর্মে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন

প্রকাশিত: ১০:৪২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুলিশের কাজকর্মে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন

শংকর কুমার দে ॥ এ কালের পুলিশ আর সেকালের পুলিশ। পুলিশের মান্ধাতা আমলের সেবা কার্যক্রমে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। বদলে যাচ্ছে পুলিশ ও পুলিশ সেবা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। পুলিশের দায়িত্ব জনগণের জানমাল রক্ষা করা, সামাজিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। নিত্যদিনের যানজট থেকে শুরু করে অপরাধী শনাক্তে এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুলিশে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করে তোলা, ট্রাফিক আইন মেনে চলতে শিক্ষার্থীসহ অন্যদের আগ্রহী করে তোলা, হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে ওঠা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ২০-৩০ বছর আগে সোর্সের মাধ্যমে শনাক্ত হতো ৯০ শতাংশ মামলা। আর এখন সোর্সের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এখন শতকরা ১০ শতাংশ কাজেও সোর্সের ওপর নির্ভর করতে হয় না। অর্থাৎ এখন প্রযুক্তির ওপর ভরসা করে শতকরা ৯০ শতাংশ মামলার কার্যক্রম শনাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কারণে। একইভাবে পুলিশের সেবাও প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। যেটা ২০-৩০ বছর আগে কল্পনারও বাইরে ছিল। পুলিশের প্রযুক্তির ব্যবহারপূর্বক সেবায় জনগণ খুবই উপকৃত হচ্ছে। ‘৯৯৯ এ্যাপ’ ॥ জনগণের সঙ্গে পুলিশের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে জরুরী হেল্পলাইন ৯৯৯ বা বিশেষ কিছু এ্যাপের মাধ্যমে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটের এ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’ এবং র‌্যাবের ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’ এর মাধ্যমে অপরাধের অনেক তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই এ্যাপটি এখন খুবই জনপ্রিয়। মানুষজন বিপদগ্রস্ত হলেই এই এ্যাপ ব্যবহার করে সেবা পাচ্ছেন। মোবাইল এ্যাপ ॥ বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যেসব আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তার মধ্যে আছে ‘মোবাইল এ্যাপ’। মোবাইল এ্যাপের এই প্রযুক্তিটি চালু হয় গত বছর। এই এ্যাপটির নাম ‘বিডি পুলিশ হেল্পলাইন’। এই এ্যাপটিতে নাম প্রকাশ না করেও অভিযোগ বা মতামত জানানো যায়। এছাড়া সেখানে সব থানার সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরও আছে। আগে যেখানে থানা পুলিশ দৌড়াঝাঁপ করে জুতার শুকতলা ক্ষয় করতে হতো। এখন সেখানে ঘরে বসেই আপনি সেই কাজ বা পুলিশের সেবা পাচ্ছেন। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন পুলিশ সেবা জনগণের নাগালের মধ্যে এসে গেছে। হ্যালো সিটি এ্যাপ ॥ পুলিশ সেবার আরেকটি প্রযুক্তি হচ্ছে, ‘হ্যালো সিটি এ্যাপ’। ‘সিটি’ মানে হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’ ইউনিট। তাদের তথ্য দেয়ার জন্য একটি মোবাইল এ্যাপ চালু করা হয়েছে। এই এ্যাপ সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, ‘জঙ্গীবাদ, উগ্রবাদ, সাইবার ক্রাইম, বোমা, বিস্ফোরক, অস্ত্র, মাদক, আন্তঃদেশীয় অপরাধ, জালিয়াতি, মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি সম্পর্কে নিজের পরিচয় গোপন রেখে পুলিশকে তথ্য প্রদান করা যাবে। আইজিপি’স কমপ্লেন সেল ॥ পুলিশের সেবার আরেকটি হচ্ছে ‘আইজিপি’স কমপ্লেন সেল’। প্রবাদ আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। নিরুপায় না হলে পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেন না সহসা। এখন পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে সেটারও অভিযোগ করতে পারছেন জনগণ। এ জন্য স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ সদর দফতরে স্থাপিত ‘আইজিপি’স কমপ্লেন সেল’। এটা ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। পুলিশ সদস্যের যে কোন অপেশাদার ও অনৈতিক কর্মকা- সম্পর্কে এই সেলকে জানানো যায়। সরাসরি, কুরিয়ার সার্ভিস কিংবা ডাকযোগে তথ্য জানানো যায়। এছাড়া টেলিফোন নাম্বার ও ই-মেইল ব্যবহার করে অভিযোগ জানানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। পুলিশ সেবার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের আশ্রয় বা থাকার জন্য ঢাকার তেজগাঁও থানা চত্বরে এই সেন্টারটি স্থাপন করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি ১০টি বেসরকারী সংস্থা সেখানে আইনী সহায়তাসহ অন্যান্য কাজ করছে। অনলাইনে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ॥ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে চালু করা হয়েছে ‘পুলিশ ক্লিয়ারেন্স’ সার্টিফিকেট। পুলিশ সদর দফতরে থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, এখন থেকে জনগণ ঘরে বসেই অনলাইন ‘পুলিশ ক্লিয়ারেন্স’ সেবা পাবেন। ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে পরে তা সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। ফরম পাওয়ার ঠিকানাও দেয়া হয়েছে। প্রবাসী সহায়তা সেল ॥ বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিকরা দেশে কোন সমস্যার সমাধানে পুলিশের সাহায্য চাইতে পারেন। এ জন্য পুলিশ সদরদফতরে ‘প্রবাসী সহায়তা সেল’ চালু আছে। মোবাইল ফোনে কিংবা ই-মেইলে যোগাযোগ করার ঠিকানা দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরে যোগাযোগ করলেই এই ধরনের সেবার সুযোগ পাচ্ছে জনগণ। পরীক্ষাগার ॥ অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। পুলিশের তদন্ত এক সময় সোর্স (তথ্যদাতা) নির্ভর হলেও সেই পন্থা থেকে অনেকটাই তারা সরে এসেছে। কোথাও কোন অপরাধ ঘটামাত্রই এখন শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের কল ও খুদে বার্তা আদানপ্রদানের তথ্য বিশ্লেষণ। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা, রাসায়নিক পরীক্ষা, ব্যক্তির বায়োমেট্রিক তথ্য, দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূত্রবিহীন ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসছে অপরাধীরা। ডিএনএ বিশ্লেষণ ॥ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলামত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম। ঘটনাস্থল থেকে শারীরবৃত্তীয় আলামত যেমন রক্ত, বীর্য, লালা বা অন্যান্য উপাদান সংগ্রহের উপকরণ ও কৌশল এখন থানা পর্যায়েও ছড়িয়েছে। ফলে ঘটনা উদ্ঘাটনে এখন ফরেনসিক ও বায়োমেট্রিক আলামতের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সিআইডির পরীক্ষাগারের এসব আলামত বিশ্লেষণের সক্ষমতা রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত ॥ অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। রাজশাহীতে সম্প্রতি ধর্ষণের শিকার হয় সাত বছরের এক শিশু। পাশবিক এ নির্যাতনের পর গলা কেটে হত্যা করা হয় তাকে। সন্দেহভাজন হিসেবে তার এক নিকটাত্মীয়কে আটক করে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে শিশুটির রক্ত, লালা এবং কাপড়ে লেগে থাকা বীর্য সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবরেটরিতে পাঠান তারা। সঙ্গে দেন আটক নিকটাত্মীয়ের রক্তও। আলামত বিশ্লেষণ করে ঘটনাস্থলে অন্য ব্যক্তির ডিএনএর মিল পান তারা। পরীক্ষকেরা জানান, ওই ডিএনএ সেই নিকটাত্মীয়েরই কোন এক ঔরসজাত সন্তানের। এরপরই শনাক্ত হয় মূল অভিযুক্ত। গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দেন তিনি। কিন্তু শেষমেষ প্রযুক্তির সহায়তায় তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই ব্যক্তি নয়, শিশুটির আরেক নিকটাত্মীয় তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। সন্দেহভাজনদের তথ্যভান্ডার ॥ অপরাধী শনাক্তে পুলিশ এখন তিনটি তথ্যভা-ার কাজে লাগাচ্ছে। প্রায় এক যুগ ধরে কারাগারে যাওয়া সব সন্দেহভাজনেরই আঙ্গুলের ছাপ, ডিএনএ, চোখের আইরিশসহ পাঁচ ধরনের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য সংগ্রহে রাখা হচ্ছে। থানাগুলোতে যাদের নামে মামলা হচ্ছে তাদের নাম, বিস্তারিত পরিচয় ও ছবি সংগ্রহে রাখছে পুলিশ। এ ছাড়া অপরাধী বা অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ শনাক্তে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভা-ার। ছদ্মপরিচয়ে থাকা কোন ব্যক্তি গ্রেফতারের পরে আঙ্গুলের ছাপ দেয়ামাত্রই জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভা-ার থেকে উঠে আসছে তার পরিচয়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কোন থানায়ও তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলে সেটি খুব অল্প সময়েই জানা যাচ্ছে। জঙ্গী কার্যক্রম শনাক্তে প্রযুক্তি ॥ বোমা উদ্ধার ও অপসারণেও যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ যন্ত্রপাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক রোবট। দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটগুলো বোমা খোঁজা, নিষ্ক্রিয় করা থেকে শুরু করে দেয়াল ভাঙা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো কাজও করতে পারে। স্পর্শকাতর কোন স্থানের নজরদারিতে পুলিশ ড্রোনও ব্যবহার করছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রযুুক্তি এখন অপরাধীর গতিপথ শনাক্ত করতে সহায়তা করছে। তদন্তে নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক পন্থা তারা অবলম্বন করছেন। প্রযুক্তির ব্যবহারে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে যন্ত্রের ফরেনসিক বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে। এখান থেকে অপরাধ প্রমাণের তথ্য যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অপরাধ সংশ্লিষ্ট অনেক তথ্যও বেরিয়ে আসে। আগে ঘটনা প্রমাণে আগে সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্যই ছিল অন্যতম প্রধান বিষয়। এখন সেই সাক্ষ্যকে আরও শক্তিশালী করা যায় প্রযুক্তির সাহায্যে ঘটনার সময়, তার অবস্থান এবং কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপরাধ সংঘটনের পর সেই স্থান থেকে আলামত সংগ্রহের বিষয়ে মাঠপর্যায়ের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আরও দক্ষ করে তুলতে হবে। পুলিশের দক্ষতা-সক্ষমতা বাড়লে মানুষজনের সেবা বাড়বে। হয়রানি কমে যাবে। আগের মান্ধাতার আমলের মতো দৌড়ঝাঁপ করে সময় নষ্ট না করে দ্রুততার সঙ্গে উন্নত সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুলিশে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×