মানব ইতিহাসে অন্যতম বিস্ময়কর অধ্যায় হলো আমাদের পৃথিবীব্যাপী বিস্তার। পূর্ব আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া হোমো স্যাপিয়েন্সরা একসময় পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া হয়ে অবশেষে আমেরিকায়। আর সেই দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের আগমন ছিল সবচেয়ে দেরিতে, কিন্তু গবেষকদের মতে এটি ছিল সবচেয়ে জটিল ও বৈচিত্র্যময় এক অভিযাত্রা।
সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক জেনেটিক গবেষণা বলছে, দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের প্রথম আগমন ঘটেছিল প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে। তবে এটি কোনো একক দলে নয় বরং একাধিক ধাপে, ভিন্ন উৎস থেকে আগত অভিবাসীদের মাধ্যমেই এই যাত্রা সম্পন্ন হয়। আর এসব অভিবাসীই পরে গড়ে তোলে চারটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী, যারা দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
সমুদ্রপথেই প্রথম আগমন?
গবেষণা বলছে, প্রাচীন এই অভিবাসীরা সম্ভবত আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সমুদ্রপথে দক্ষিণ আমেরিকায় পা রাখে। পূর্ব দিক থেকে আসা এসব মানুষদের মধ্যে ছিল আফ্রিকা থেকে আগতদের রক্তধারা, আবার কিছু কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য অস্ট্রোনেশীয় ও ওশেনীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও মিল খুঁজে পেয়েছে গবেষকরা।
খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ সালের মধ্যেই এসব অভিবাসীরা স্থানীয় আবহাওয়া ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে গড়ে তোলে নতুন জীবনধারা। এ সময়েই চারটি আলাদা জেনেটিক জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে যারা পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়ে গড়ে তোলে পৃথক সমাজ।
গড়ে ওঠে শত শত সংস্কৃতি
প্রথম দিকে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে এসব মানুষ বেঁচে থাকত কৃষিকাজ, শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা একেকটি জটিল ও সংগঠিত কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় পরিণত হয়। গড়ে ওঠে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারস্পরিক লেনদেন।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত, অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান একসময় দক্ষিণ আমেরিকার জনবিন্যাসে নিয়ে আসে বড় পরিবর্তন। এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ; কখনও সংঘাতে, কখনও সহযোগিতায় গড়ে তোলে নতুন সমাজব্যবস্থা।
দক্ষিণ আমেরিকা ছিল ‘শূন্য ভূমি’ নয়
প্রচলিত ধারণা ছিল, দক্ষিণ আমেরিকা ছিল একপ্রকার জনমানবশূন্য অঞ্চল যেখানে মানুষ আসার পর ধাপে ধাপে সব গড়ে উঠেছে। কিন্তু নতুন গবেষণা জানাচ্ছে এক ভিন্ন গল্প। দক্ষিণ আমেরিকা ছিল এক প্রাচীন, জীবন্ত ভূখণ্ড, যেখানে বহু জাতিগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে বসবাস করে গড়ে তুলেছিল এক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক চিত্রপট।
জেনেটিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মিলিয়ে এখন গবেষকরা বলছেন, দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের আগমন কোনো একক পথ বা সময়ের ঘটনা নয় বরং এটি ছিল বহু পথ, বহু মানুষ ও বহু সংস্কৃতির সম্মিলিত ফল।
দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের প্রথম আগমনের এই কাহিনি আজ আমাদের সামনে উন্মোচন করছে মানব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। আধুনিক গবেষণায় উঠে আসা জেনেটিক তথ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার বলছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিল অদম্য অভিযাত্রী, যারা মহাসাগর পেরিয়ে গিয়ে গড়ে তুলেছিল নতুন সমাজ, নতুন সংস্কৃতি ও নতুন সভ্যতা।
এখনকার এই বৈচিত্র্যময় দক্ষিণ আমেরিকা তাদেরই উত্তরসূরি। এই ইতিহাস কেবল ভৌগোলিক বিস্তার নয়,বরং এটি মানুষের অভিযোজন, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির বহমানতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সূত্র:https://tinyurl.com/4sfyfxzk
আফরোজা
