মর্গ স্ট্রিটের হত্যা রহস্য
১৮ সালের বসন্তকাল আর গ্রীষ্মের কিছুটা সময় আমি প্যারিসে কাটিয়েছি। সেই সময় মঁসিয়ে অগাস্ট দুপঁ নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। ভালো পরিবারের সন্তান এই যুবক, ভাগ্যের ফেরে এখন আর্থিক দুর্দশায় পড়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে বাপের কাছ থেকে কিছু সম্পত্তি পেয়েছিল দুপঁ- পাওনাদারের দেনাটেনা মিটিয়ে এখনো অল্প কিছু সম্পত্তি রয়ে গেছে। তাই দিয়ে কোনোমতে দুপঁর চলে যায়। ওর একমাত্র বিলাসিতা বই কেনা, আর প্যারিসে তো বইয়ের কোনো অভাব নেই।
দুপঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় মমাঁর্ত স্ট্রিটের লাইব্রেরিতে। একই বই খুঁজছিলাম আমরা দুজনÑদুর্লভ একটা বই, সেই থেকে পরিচয়। এরপর প্রায়ই দেখা করতাম আমরা। দুপঁর পারিবারিক ইতিহাস জেনে ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম আমি। ওর ব্যাপক পড়াশোনা দেখেও মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
শেষে আমরা ঠিক করলাম দুজনে একসঙ্গে থাকব। আমার আর্থিক অবস্থা দুপঁর চেয়ে কিছুটা ভালোÑ আমি থাকি পুরনো আমলের একটা পোড়ো বাড়িতেÑ নানারকম ভুতুড়ে গল্প শোনা যায় বাড়িটাকে ঘিরে, তবে সেসব পাত্তা দিই না আমি। এই ভুতুড়ে বাড়িতেই আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম।
আমাদের প্রতিদিনের রুটিন ছিল অদ্ভুতÑ লোকে শুনলে হয়তো ভাববে পাগলের বাস এই বাড়িতে। বাড়িটা নির্জন এলাকায়। কেউ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতো না। আমার বন্ধুরাও জানতো না আমি এখানে থাকি। ভোরের আলো ফুটে উঠলেই আমরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিতাম, তারপর আধো আলো আধো অন্ধকারে যে যার মতো লেখাপড়ায় ডুবে যেতাম কিংবা গল্প-আড্ডায় মেতে উঠতাম।
এক সময় ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দিত সন্ধ্যা হয়েছে। তখন আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম। ঘুরে বেড়াতাম শহরের এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায়। আমাদের গল্প চলতে থাকতো আর নীরব রাস্তায় যা কিছু চোখে পড়তোÑ সেসবই আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম। তখনই প্রথম বুঝতে পারি আমার বন্ধুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। সে নিজেও সেটা জানতো।
সেজন্য চাপা একটা গর্ববোধও ছিল তার মনে। কোনো কিছু পর্যবেক্ষণ করার সময় সে যেন অন্য মানুষে পরিণত হতোÑ নির্লিপ্ত, গম্ভীর এবং দূরের মানুষ। এই সময়টাতে তার গলার স্বরও কিছুটা বদলে যায়। এমনিতেই তার গলা তীক্ষè ও উঁচু তারে বাঁধাÑ কোনো কিছু বিশ্লেষণের মুহূর্তে তা যেন বেড়ে তিনগুণ হয়ে যায়, আর তাতে যোগ হয় কিছুটা ছেলেমানুষি ভাব। এ রকম মুহূর্তে দুপঁকে দেখে মানুষের দ্বৈতস্বত্বার কথা মনে পড়ে আমার।
সংক্ষেপে বলা যায় এই ফ্রেঞ্চ যুবকের মধ্যে অবিশ্বাস্য যুক্তি-বুদ্ধির প্রকাশ দেখতে পাই আমি প্রায়ই। একটা ঘটনা দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করি ব্যাপারটা।
একদিন রয়্যাল প্যালেসের কাছে একটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা রাতের বেলা। দুজনেই নিজের নিজের চিস্তায় মগড়ব ছিলামÑ প্রায় পনেরো মিনিট ধরে নীরবে পাশাপাশি হাঁটছি। এই পনেরো মিনিটে একটা কথাও হয়নি। হঠাৎ দুপঁ বলে উঠলো, ‘লোকটা বেঁটে হলেও কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ভালো করবে।’
‘ঠিক বলেছো।’ নিজের অজান্তেই আমি সায় দিলাম দুপঁর কথায়। পরমুহূর্তে মনে হলোÑ আরে আমি যা ভাবছি ঠিক সেই কথাটাই দুপঁ কীভাবে বলে দিল? তাজ্জব ব্যাপার!
‘দুপঁ?’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এ তো থট রিডিং? যে কথাটা আমি ভাবছি মনে মনেÑ তা তুমি হুবহু বলে দিলে কীভাবে? আমি ভাবছিলামÑ’ এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলাম...
‘চ্যানটিলির কথা।’ দুপঁ আমার অসমাপ্ত বাক্যের বাকিটা বলে দিল। ‘থামলে কেন? চ্যানটিলির কথা ভাবছিলে তুমি। ভাবছিলে এই অভিনেতার ছোটখাটো ফিগারটা ট্র্যাজিক চরিত্রের উপযুক্ত নয়।’
ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলামÑ অভিনেতা চ্যানটিলি একসময় সাধারণ একটা জব করতো। নিজের চেষ্টায় আর যোগ্যতায় অভিনয় জগতে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু ইদানীং একটা নাটকে ট্র্যাজিক পার্ট করতে গিয়ে বেচারা একদম ফ্লপ করেছে। কিন্তু দুপঁ কী করে জানলো আমার মনের কথা!
‘না রে ভাই, ঠিক করে বলো।’ চেপে ধরলাম বন্ধুকেÑ অবাক হওয়ার চেয়েও বেশি চমকে গেছি আমি। ‘কীভাবে তুমি টের পেলে আমি কী ভাবছি?’
‘ফল বিক্রেতা।’ জবাব দিল বন্ধু। ‘ফলবিল্ডেতা থেকে অভিনেতার দেহের উচ্চতার কথা এসেছে তোমার মনে।’
‘ফল বিল্ডেতা! কী বলছো এসব? আমি তো কোনো ফল বিল্ডেতাকে চিনিই না।’
‘প্রায় পনেরো মিনিট আগে এই রাস্তায় ঢুকার মুখে তার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছো তুমি।’
হ্যাঁ এবার মনে পড়লোÑ ঝাঁকাভর্তি আপেল নিয়ে একজন ফল বিল্ডেতা যাচ্ছিল একটু আগে। এই রাস্তায় ঢুকার মুখেই লোকটার সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগে। আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে চ্যানটিলির কী সম্পর্ক?
‘বলছি শোনো।’ ব্যাখ্যা শুরু করলো দুপঁ। ‘একদম গোড়া থেকে শুরু করিÑ যাতে বুঝতে সুবিধা হয়। তোমার চিন্তাকে অনুসরণ করবো আমরাÑ যে মুহূর্তে আমি অভিনেতার কথা বলেছি তোমাকেÑ সেই মুহূর্ত থেকে পিছিয়ে যেতে থাকবো তোমার চিন্তা অনুসরণ করে। পিছাতে পিছাতে ফল বিল্ডেতার সঙ্গে ধাক্কাা খাওয়ার ঘটনা পর্যন্ত চলে যাব। তোমার চিন্তার ট্রেনটা ছিল এ রকমÑ চ্যানটিলি...সপ্তর্ষি...এপিকিউরিয়াস...স্টেরিওটোমি...পথের-পাথর...ফল বিল্ডেতা।’
বন্ধু দুপঁর কথায় ভীষণ অবাক হলাম। তারপরও মনে হচ্ছিল সে বোধহয় ঠিকই বলছে। এভাবে অনেক সময় নিজের চিন্তাকে ব্যাক ট্র্যাক করি আমরা। তখন অবাক লাগে এই ভেবেÑ আরে! কোথা থেকে শুরু করেছিলাম আর কোথায় এসে শেষ হয়েছে আমার ভাবনা! দুপঁ বলে চললোÑ
‘পাশের রাস্তা থেকে এই রাস্তায় ঢুকার আগে আমরা ঘোড়া নিয়ে আলাপ করছিলাম, যতদূর আমার মনে পড়ে। হ্যাঁ, ঘোড়াই ছিল আমাদের আলাপের বিষয়। তারপর আমরা এই রাস্তায় প্রবেশ করলাম। রাস্তার মুখেই ফল বিল্ডেতা আমাদের গা ঘেঁষে গেল। তার সঙ্গে তুমি ধাক্কা খেলে। সেখানে পথের ওপর কিছু নুড়ি-পাথর ছিলÑ ফুটপাথ মেরামতের জন্য।
পাথরে পা পিছলে তুমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলে। পাথরের স্তূপটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে কী যেন বললেও বিড়বিড় করে...। এসব আমি কিন্তু সচেতনভাবে লক্ষ্য করিনি। আসলে নিজের অজান্তেই ননস্টপ পর্যবেক্ষণ করে যাওয়ার অভ্যেসটা ইদানীং আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
যা হোক, মাটির দিকে চোখ রেখে তুমি হাঁটছিলে- তোমার চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তির ভাব ছিল। তার মানে তোমার চিন্তায় তখনো পাথরের টুকরোর কথা খেলা করছে। এই সময় আমরা পরের গলিটাতে ঢুকলাম।
এখানে ফুটপাথ নতুন করে বাঁধানো হয়েছে। ডিজাইনটাও নতুন- পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে ডিজাইনটা। এসব দেখে তোমার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তুমি বিড়বিড় করে একটা শব্দ উচ্চারণ করলে বারদুয়েক। শব্দটা ছিল ‘স্টেরেওটোমি’- এটা পাথর কাটার নতুন একটা পদ্ধতি- এই পদ্ধতিতে পাথর কেটে আজকাল অনেক ফুটপাথ বাঁধানো হচ্ছে। লক্ষ্য করো- ‘স্টেরেওটোমি’ শব্দটার সঙ্গে মিল আছে ‘এটম’ শব্দের। (চলবে...)