
-
যত রাত ডোরাকাটা
অহ নওরোজ
যখনই গাছে গাছে হাওয়ারা ঘোরে
পাখিরা চাঁদের দিকে লক্ষ্য করে ওড়ে
আর কিছু পরে বুকের ভেতর এক
অদ্ভুত বাতাস নিয়ে ফিরে ফিরে আসে—
সবগুলো দরজায় যখনই দেখি
বাহির বাহির স্নিগ্ধ ঘ্রাণ মেখে গেছে,
ছায়ারা শিখার মতো ম্রিয়মাণ নড়ে
ডোরাকাটা জোছনায় গলে পড়ে যাচ্ছে
মনে হয় যেন বহু পূর্বকাল থেকে
যাবতীয় সব অপরাহ্নের শরালে
বসন্তের রাতগুলো ঘন জমে ছিলো-
তাদের পালকে আগুনের হল্কা নিয়ে
ওড়ার তরল শব্দে রাত্রি কাঁপে ফের,
আর ছায়া বাড়ে পৃথিবীর করোটিতে-
** চলো একটু বসি
বহ্নি কুসুম
খুব করে চাই-
হুট করে দেখা হয়ে যাক দুজনের
কাঁধের বোঝাই কাজ নামিয়ে দাঁড়াই
মুখোমুখি। স্থির দিঘল ও চোখে
ঝাঁপি খুলি দুরন্ত কৈশোর।
চিবুকের কাটা দাগে ছুঁয়ে দিই স্মৃতির আকর
দ্বিধান্বিত হাতটি ধরে বলি-
চলো, কোথাও একটু বসি
খানিক জিরিয়ে নিই।
ব্যর্থ জীবনে কষ্টপাহাড় বইতে বইতে
ভীষণ ক্লান্ত আমি।
সেই যে অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখেও
ফিরলে না আর।
প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে
পুড়তে পুড়তে প্রবল দিকভ্রান্ত
ম্যারাথন নগরের ঘোড়সওয়ার
ছুটছি, ছুটছি তো ছুটছি
আমার বুকের লেলিহান আগুনে দগ্ধ
নাগরিক পিচঢালা পথ।
দীর্ঘজ্যামে ঝিমোতে থাকা পাথর মানুষ
বেলোয়ারি স্বপ্নের সদাই-পাতিতে
ঘরে ফিরছে ফিরুক।
ভেতরে আর্তনাদ নিয়ে দাঁড়ানো প্রাসাদ
থাক না অদূরে আজ।
মরুতপ্ত এ দুপুর সরিয়ে
বাসন্তী গোধূলিমা সন্ধ্যায় চলো
কাটাবো একটা বেলা।
** মার্চের উদ্যান
আনোয়ার কামাল
আমরা যে যার মতো করে বাড়ি
চলে এসেছিÑ জ¦লজ¦লে স্বাধীনতা স্তম্ভ
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে
অমর একুশে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
আলোকিত মাসব্যাপী চেনা-অচেনা আবেগী মুখ
সবকিছু স্মৃতির ক্যানভাসে আঁকা ছবি হয়ে আছে
আমরা যে যার মতো করে বাড়ি চলে এসেছি
ফেব্রুয়ারির শোকাঞ্জলি পেরিয়ে মার্চের উদ্যান
পিতার উদাত্ত আহ্বানÑ কানে বেজে ওঠে
আমরা ফেব্রুয়ারির শোকার্ত নীরব থেকে
মার্চের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
** কবর
মুশারাত
আমিতো মৃতই ছিলাম
তোমাদের কাছে
কবে আর আসতে কেমন আছি
দেখতে, কবে আর জানতে চেয়েছো
আমার শরতের আকাশে মেঘ আছে কীনা।
আমিতো মৃতই ছিলাম
আনন্দের কাছে বা স্বপ্নের পিছে,
শেষ বেলার খোলাছাদে
রোদের কাছ থেকে এক টুকরো কমলা রঙও
চুরি করা হয়নি আমার
কতদিন চেয়েছি তোমাদের সাথে
পানগুচিতে পা ভেজাবো
তীব্র মুখরতা নিয়ে, চৈত্রের বৃষ্টিতে ভেজা
উল্লাস নিয়ে- হয়নি তো!
আমি কবে আর জেগে ছিলাম-
কলুষিত সকালেই ঢেকেছে সব ভোর
কবে আর দেখেছি বংগোপসাগরে
সূর্যের ডুবে যাওয়া তার হাতটি ধরে
কবে আর জানিয়েছি শুভরাত্রি বা
শুভ সকাল তোমাদের
কবে আর জ্বলেছে একটা মোমের বাতি
মসলিন বিছানো ডাইনিঙ টেবিলে
শুধু আমার জন্য
কবে আর ভিজেছে কেউ আমার অশ্রুতে
আজ কেন তবে অশ্রু দিয়ে গড়ছো মহাসাগর
আমি তো কেবল মাটি থেকেই মাটিতে নেমেছি
- তোমরাই আজ জ্বেলেছো
প্রদীপ, সুবাসিত ধূপ, আগড়।
** অজান্তা
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
যেভাবে দাঁড়িয়ে আছি তৃষ্ণার চোখে
যেন আলোকবর্ষ ধরে প্রতীক্ষায়
ক্ষয়ে যাচ্ছি একা একা
আয়নার ভেতর
কেউ জানে না
যেন দুটি চোখ লুপ্ত নগরীর দ্বার
মাটিচাপা উৎপীড়নে
বেজে যাচ্ছে শেষ ট্রেন
গন্তব্যহীন
কেউ জানে না
ঢেউয়ের হিসেব কি রাখে নদী?
যেমন রাখে না পথ, পদচিহ্ন
অলৌকিক পাহারা ভেসে যায়
বিহ্বল
কেউ জানে না।
আমি এক তৃষাতুর নদী
নিজেকেই ভাঙছি
ঢেউ ও ঝড়ে
কেউ জানে না।
** কথার কথা
মাহবুবা ফারুক
তোমাকে ঠোঁটের কাছে টেনে আনতে আনতে
তুমি মিলিয়ে যাও হারিয়ে যাও
জোর করে টেনে আনবো বলে খুঁজতে থাকি
লজ্জা নাকি অন্য কিছু জানিনা
কিছুতেই ঠোঁট পর্যন্ত আসো না
ঠোঁট ছুঁয়ে চলে গেলে কি হতো
অন্ততপক্ষে কেউ আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলে
সে তো কানও স্পর্শ করতে পারতো
তারপর কী হতো জানি না,
এক সময় আবেগ থেমে যায়
এক সময় তোমাকে ভুলে অন্য কাউকে
অন্য কাউকে —
এভাবে কেউ হয়তো প্রকাশ হয়
কেউ থাকে চির আড়ালে চির অজানা
সে অন্য কারো ঠোঁট অতিক্রম করলে করতে পারে
আমার নয়।
যে আমার হয়নি সে অন্য কারো তো নিশ্চয়
কতজনকেই এভাবে মনের ভেতর রাখলাম
ঠোঁটের কাছে আনতে পারিনি।
** পরাধীন থাকতে চাই
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
চোখের সামনে যা কিছু এরা যেন
কখনোই আমার উপনিবেশ না হয়।
আমি যদি ফুলের অধীন থাকি
তাহলে ফুল ছিঁড়ব না।
আমি যদি চাঁদের অধীন থাকি
তবে জ্যোৎস্না কলুষিত হবে না।
আমি যদি ভাবি
আমি সীমিত সময়ের কাছে বাঁধা
সময় নষ্ট হবে না।
এই স্বৈরাচারী চোখ যেন কখনোই
এই গাছপালার উপর না পড়ে
বরং গাছগুলি আমাকে দেখুক।
পৃথিবীর প্রত্যেকটা ধূলিকণার কাছে
আমি পরাধীন থাকতে চাই।
পথের উপর দাঁড়িয়ে আমি
নিজেকে ছেড়ে দিতে চাই-
পথ যেদিকে নেবে
আমি সেদিকে যাবো।
শুধু বলবো- আমার গন্তব্য এটা
হে পথ, পৌঁছে দাও তুমি।
** বিশ্বাসে প্রতিদিন
কুমকুম দত্ত
ভাঙে ঘুম বিশ্বাসে প্রতিদিন
প্রাচীর স্বপ্নের সিঁড়ি পার হয়ে যাই
চেনা মুখ মাঝে মাঝে সাক্ষাতে অচেনা
মনে ঢেউ বেহাল সময় সমুদ্র সমান।