ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১০ আগস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

সেলিম আজাদ চৌধুরী

গল্প ॥ দোলনচাঁপা

প্রকাশিত: ০০:৪০, ২৯ জানুয়ারি ২০২১

গল্প ॥ দোলনচাঁপা

নালার ঠাণ্ডা পানিতে পা ফেলে হাঁটতে থাকে ইন্দ্র আর সে। নালী মানে যেখানে মাছ ধরার ফাঁদগুলো পাতা আছে। সেটি একটু দূরে। সে পর্যন্ত যেতে ওদের আরো একটু হাঁটতে হবে। নালাটায় এতটুকু কাদা নেই। চিরচিরে পানির নিচে বালি। পানি একবারেই কম। কোথাও পায়ের পাতাটা শুধু ডুবে। আবার কোথাও হাঁটুর নিচে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, পানি নেই বলেই কি লোকে এটিকে মরা ছরা বলে। ইন্দ্র তার বছর দুয়েকের বড়। বয়সে বড় বলে কথা নয়। সে ইন্দ্রকে গুরু মানে অন্য কারণে। ওর মনে হয় ইন্দ্রের অজানা কিছু নেই। ইন্দ্র গ্রামে থাকে। পড়ে গ্রামের স্কুল। পড়া লেখা বলতে একদিন স্কুলে গেল তো পরের দুদিন বাবাকে এটা সেটায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে, সংসারের কাজে স্কুল কামাই। আর সাদী জেলা শহরের বাসিন্দা। পড়ে সরকারী পাইলট হাইস্কুলে। পড়ালেখায় ফাঁকি ঝুঁকি নাই। তারপরও সে লক্ষ্য করেছে বিভিন্ন বিষয়ে ইন্দ্রের প্ল্যান তার চেয়ে বেশি। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে, কি করে ইন্দ্র এসব আয়ত্ত করল। তাই এবারও সে ইন্দ্রকে গুরু মেনে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, বলতো ইন্দ্র, এই নালাটাকে লোকে মরা ছরা বলে কেন? ইন্দ্র বলল, দেখস না ছরাতে পানি নাই। হয়তো এই কারণেই মরা ছরা বলে। বর্ষার সময়? তখনও কি এখানে এমন পানিই থাকে? ইন্দ্র বলল, আরে না। তখন এটা টইটুম্বুর। শুধু তাই না, তখন এটা ভয়ঙ্কর খরস্রোতা। ছোটরা নামতে পর্যন্ত সাহস পায় না। একবার তো আমি প্রায় ভাইসাই গেছিলাম। বাবা না থাকলে সেবার আমি পানির তোড়ে কোথায় তলাইয়া যেতাম, ঈশ^র জানেন। এই ছরায় পানি থাকে না শুধু মাস দুই তিনেক, বিশেষত শীতের সময়। তুই দেশে আসিস শীতে। তখন সে রোগা,পানি শূন্য। তাহলে তুই বলছিস শীতের কিছুদিন ছাড়া প্রায় সারা বছরই পানি থাকে। তাই না? হাঁ, তাই। তবুও লোকে বলে মরা ছরা। কথাটা সাদী এমন অন্যমনস্কভাবে বলল যে, ইন্দ্র হাঁটা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদী বলল, কিরে দাঁড়িয়ে পড়লি যে? তোর কথার মানে বুঝতে পারলাম না। আবার হাঁটতে হাঁটতে ইন্দ্র বলল। নারে, ও কিছু না, চল। সাদী বলল। কথা লুকাইতেছস কেন? বলই না। সাদী হেসে ফেলে। আরে আমি কি মানুষের মনের কথা বুঝি নাকি যে তোকে বলব? কি বুঝিস না? এই যে সারা বছর পানি থাকে শুধু মাস ২/৩ ছাড়া। তবু কেন মরা ছরা বলে মানুষ? ইন্দ্র আবার সাদীকে দেখে। তার কাছে সাদীকে অচেনা লাগে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, বাদ দে। চল আমরা যাই দেখি চাইগুলোতে কি মাছ লাগল। এত বছর হয়ে গেল তারপর কিশোর বয়সের কথাগুলো পরিষ্কার মনে পড়ে। ঘরের ভেতর ভ্যাঁপসা গরম। নিজের গায়ের ঘামের গন্ধ পর্যন্ত নাকে লাগছে। সেটা কিভাবে সম্ভব? কেউ কি নিজের গায়ের গন্ধ অনুভব করে? মনে হয় না। সাদী ভাবে, তাহলে যে মোজার গন্ধ কিংবা গেঞ্জির গন্ধ নাকে লাগে কেন? হয়তো সেটা অত্যন্ত সচেতনভাবে করলে লাগে। কিন্তু অনুভবতো আর সে রকম নয়। অনুভব হলো সন্তপর্ণে ইন্দ্রিয়ের ভেতর সাড়া জাগানোর মতো। অনেকটা ইয়ের মতো.......। মানে ইয়ের মতো.. .. ...। ইয়েটাকে পরিষ্কার করে ধরতে পারে না, সাদী। কিছু একটা মনের দুয়ারে এসেই আবার আলেয়ার মতো সরে সরে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে সে অনুভবটা আসলে কি। অনেক কিছুই তার মনে আসে। তবে সে যা ভাবছে তার সঙ্গে কোনটাই যুত সই মনে হয় না। চোখ বন্ধ করে ভাবছিল। এবার চোখ খুলে চারপাশে তাকাল। ঘরটা আধো অন্ধকার। মেয়েটা আসে দিনের বেলা। যখন সে আসে ঘরের জানালা দুয়ার বন্ধ করে দিতে হয়। বন্ধ ঘরটা কিছুক্ষণের ভেতর উনুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। অনেক দিন ভেবেছে, মেয়েটা যদি রাতে আসত ঠাণ্ডা পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করা যেত। তাকে রাতে আসার কথাটা মুখের কাছে এসে ফেরত গেছে বলতে পারেনি। সাদীর মনে হয়, মেয়েটা তার সংসারের বাসিন্দা। যদি মেয়েটার বিয়েশাদী হয়ে থাকে তাহলে স্বামীর সংসার ও নিজের সংসার। আর যদি এখনও বিয়েশাদী না করে তাহলে বাবা-মায়ের সংসার। সেটাও নিজের সংসার। কোন সংসারই তাকে রাতের বেলা তাকে বাইরে থাকতে অনুমতি দেবে না। কাজেই মেযেটাকে সাদীর বাসায় রাত কাটানর প্রস্তাব দেয়াটা বোকামি হবে। তারপরও সাদীর মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করতে পারে না। তখন মনে খেলে যায়, বাজারের মেয়েদের আবার কিসের রাত আর কিসের দিন। কিন্তু কোন চিন্তাই তার মনের আড়ষ্টতা কাটাতে পারে না। প্রস্তাবটা দেয়ার জন্য যখনই মনকে প্রস্তুত করতে চায় তখনই তার চিন্তাটা ঝিমমেরে যায়। অথচ মেয়েটা সাদাসিদা কিসিমের। প্রথম যেদিন সে আসলো সেদিনই এক সময়ে হেসে বলল, আপনাকে কেমন যেন ডারলিং ডারলিং লাগছে। কথাটা শুনে সাদীর মেজাজ গরম হয়ে উঠেছিল। বলে কি একটা রাস্তার মেয়ে? দশজনের সঙ্গে শোয় আর আমাকে নাকি ডারলিং ডারলিং লাগে। সাদী প্রায় মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিল, যার সঙ্গে শুতে যাও তাকেই কি কথাটা বল? নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য সাদী অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আর তখনই চোখ পড়ে যায় আনার উপর। নিজকে দেখে অন্যসব কথা ভুলে যায় সাদী। তার দেহ সৌষ্টব ভাল। চেহারায় একটা মায়াবী ছাপ আছে। উপরের সৌন্দর্য চাপিয়ে তার হৃদয়ের কোমল দিকটার কথা ভেবে এতদিন সাদীর মনে হত সে ঐশ্বর্যবান। অন্যদের থেকে আলাদা। তার সব কিছু দিয়েই সে অরুনিমাকে ভালবেসেছিল মনেপ্রাণে। কিন্তু বেঁধে রাখতে পারল কই? কথাটা মনে হতেই বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠে সাদী। নিজের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মন। আয়না থেকে চোখ ফিরিয়ে মেয়েটাকে দেখে। এখনও হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। কত হবে বয়স, ২০ কি ২২, বড় জোর ২৫ হতে পারে। শ্যামলা গায়ের রং। চেহারাটা আটপৌরে। গরিব ঘরের মেয়ে দেখলেই অনুমান করা যায়। সাদীর কষ্ট লাগে মেযেটার জন্য। সম্পন্ন ঘরের হলে এই বয়সে পড়ালেখার সঙ্গে তার দুচোখে স্বপ্ন ঘিরে থাকত। সাদীর অন্যমনস্ক ভাব দেখে মেয়েটা ঠাট্টা করে, ঘরে মেহমান দেখে ফাঁপরে পড়ে গেলেন নাকি? দিনে দিনে মেয়েটার কাছে সহজ হলেও তাকে রাতে আসার কথাটা বলা আর হয়না। ময়েটি চলে গেলে শুয়ে শুয়ে সাদী ভাবে সারারাত যদি মেয়েটার সঙ্গে থাকতে পারত স্বামী-স্ত্রীর মতো। এই ইচ্ছাটা দিনে দিনে প্রবল হয়েছে কিন্তু প্রকাশ করা হয়নি। মেয়েটার সঙ্গে এত মেলামেশা করে তবুও তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারে না। কোথায় জানি একটা বাধা আছে। সে বুঝতে পারে না বাধাটা কিসের। সেটা কি তার নিজের মনের দুর্বলতা? তা কেন হবে। তবে কি মেয়েটাকে সস্তা ভাবে বলে? আর সে কারণে কেবল একটা কাজের বাইরে আর কিছুই ভাবতে চায় না। নিজের প্রতি তার আত্মবিশ্বাস কি এতই প্রবল? তাতো মনে হয় না। তাহলে, মেয়েটার সঙ্গে স্বাভাবিক হওয়ার বাধাটা কি, মেয়েটার ব্যক্তিত্ব? সাদাসিধা মনে হলেও মেয়েটা যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেটি ওর চোখের দিকে তাকালে বুঝা যায়। কি গভীর দৃষ্টি। সরাসরি চোখে চোখ রেখে কথা বলতে কেমন যেন আড়ষ্ট লাগে। নিজের চরিত্রটাকে নিজের কাছে অস্বাভাবিক লাগে সাদীর। চুক্তিবদ্ধ কাজের বাইরে জগতের আর কোন বিষয়ে মেয়েটার আগ্রহ নাই। সাদীর হাসি লাগে নিজের বোকামির জন্য। কি আর আশা করে মেয়েটার কাছে? ধুস শালা, কিসব আবোল তাবোল ভাবছে সে। কতক্ষণ আগে মেয়েটা বিদায় নিয়েছে। তার চলে যাবার পরও জানালা আর খোলা হয় নাই। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরের আবছা আলোয় চারদিকে তাকিয়ে ঘরটিকে কেন যেন নিজের বলে মনে হয়না। প্রতিবারই এমন লাগে। তারপর ধীরে ধীরে এক সময় সবকিছু আবার আগের জায়গায় চলে যায়। এ বড় অদ্ভুত অনুভূতি। আজও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে। দুজন মানুষের দপাদপিতে বিছানাটা হয়ে পড়েছে এলোমেলো। তার উপর গরমে ঘামে বিছানাটা স্যাঁত-সেঁতে হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে নাকে লাগে একটা বিদঘুটে গন্ধ। মাথাটা ধরে আসে। শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে। মনে পড়ে, একটু আগে ভাবছিল অনুভূতিটা কেমন? তাৎক্ষণিকভাবে অনুভূতির একটা তুলনা চকিতে মনে আসে। কিন্তু তুলনাটা কিসের সঙ্গে সেটি আর মনে করতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি মনের ভেতর। দিনকে দিন কি হয়ে যাচ্ছে সে। ঠিকমতো আর কিছুই মনে করতে পারে না। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। জানালাটা খুলতেই ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ লাগে চোখেমুখে। তখনই মনে পড়ে যায় কিশোর বয়সে নালার ঠাণ্ডা পানিতে ইন্দ্রের সঙ্গে হাঁটার কথাটা। মানুষের মন যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায় তার হদিস পাওয়া বড় মুশকিল। তার মনে পড়ে, সে ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন মানুষ নালাটাকে মরা ছরা বলে? ইন্দ্রের উত্তর তার মনোপুত হয়নি। তার মনে হয়, মরা ছরা মানে যে ছরায় পানি থাকে না। কিন্তু ২/৩ মাস ছাড়া প্রায় সারাটা বছর পানি থাকে তবুও ছরাটাকে সবাই মরা ছরা বলে। এত বছর পর সাদীর যেন মনে হয় তার জীবনটাও মরা ছরার মতো। বেঁচে থেকে মানুষ যা করে সেও তাই করছে। সকাল বিকেলের চাকরি, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে নারীর শরীরের আঁশটে গন্ধ বাদ যায় না কিছুই। মানুষের মতো চলছে ফিরছে তবু যেন কি একটা শূন্যতার ভেতর সে ডুবে আছে। মানুষ হিসাবে úূর্ণ হতে পারছে না। আজও দুপুরের পর এসেছিল মেয়েটি। কি যেন একটা নাম বলেছিল? চিনু নাকি বিনু ঠিক মনে পড়ে না। যাই হোক, যে নামই থাকুক সাদীর কাছে তা কোন ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। তবে মনে আছে, প্রথম বার যখন শুনেছে নামটি মিষ্টি লেগেছে। কেবল তখন একবারই নামটি উচ্চারণ করে বলেছে, বেশ সুন্দর নামতো। সাদীর বিশ্বাস হয় না নামটি মেয়েটির আসল নাম সেটা। প্রথম বার যে উচ্চারণ করেছে, সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ। তারপর আর কখনও সেই নামে ডাকতে তার অভিরুচি হয়নি। কেন হয়নি সেটি বুঝিয়ে বলা দুরূহ। তার মনে হতো, মেয়েটিকে চিনু বা বিনু নামে কেবল একজনেরই ডাকা সাজে। আর সে হলো তার প্রেমিক। সাদীতো আর তার প্রেমিক নয় যে সেই নামে ডাকবে। সাদীর মনে হয়, মেয়েটির কি কোন প্রেমিক আছে? হয়তো আছে, হয়তো নাই। কে জানে? তার মনে হয়, বিভিন্ন জনের সঙ্গে যে মেয়ে সময় কাটায় তার কি একজনের সঙ্গে প্রেম হতে পারে। মনে হয় না? এরা মানুষের উপর আস্তা হারিয়ে ফেলে। তাহলে আর প্রেম হবে কিভাবে? প্রেমের ক্ষেত্রে একজন আরেক জনকে বিশ্বাস করতে হয়। তার মনে প্রশ্নের উদয় হয়, এমন কি কেউ আছে যে, মেয়েটার অবস্থা জেনেও তাকে ভালবাসতে পারে? সাদীর মনে হয় তার ভালবাসার নারী ছিলএক সময়। এখন কেউ নাই। তারও খুব ইচ্ছে করে কাউকে ভালবাসতে। আজ মেয়েটাকে কেন জানি অন্যরকম লাগছিল। অন্য সময় এসেই বড্ড তাড়াহুড়া করে। এত তাড়াহুড়াতে সাদীর রুচি হয় না। তার মনে হয় ওটা পশুদের কাজ। সে চায় একটু সময় নিতে। যেটি মেয়েটির কাছে পাওয়া যেতনা। প্রথম প্রথম দু’একবার সাদী চেষ্টা করেছে সময় নিতে। মনে পড়ে, প্রথম দিনের কথা। মেয়েটার সঙ্গে দুএক কথার পর সাদী তাকে সোফায় বসতে ডাকছিল। মেয়েটা তখন সামনে ওয়্যারড্রোবের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল হাসিমুখ করে। যেখানে ছিল সেখান থেকে উত্তর করল, সোফায় কেন? তুমি না একটু আগে বললে আমাকে ডারলিং ডারলিং লাগছে। এসো, বসে একটু গল্প করি। মেয়েটা হেসে উত্তর করেছে, সত্যি বলেছি নাকি? আপনি যেমন চাচ্ছেন সেটা প্রেমিকার কাছে প্রেমিক চায়। আপনি কি আমাকে আপনার প্রেমিকা ভাবেন? এমন তির্যক প্রশ্নের জন্য সাদী প্রস্তুত ছিল না। একটু অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। তারপর একটু হেসে ঠাট্টার ছলে বলল, অসুবিধা কি? কিছুক্ষণের জন্য তো প্রেমিকাই। মেয়েটি বলল ভালই বলেছেন, প্রেমের শেষ যখন শরীরে। তখন তো বলতেই পারেন তা। তারপর চটুল হেসে বলেছে, তাহলে আর প্রেমে দেরি কেন? তারপর চটপট কাপড়চোপড় ছেড়ে উলঙ্গ শরীরটা সাদীর গায়ে ঘষতে থাকে। তখন সাদীর সকল অনুভব পাক খেতে খেতে এক জাগায় কেন্দ্রীভূত হয়। কেবল একটা কাজ ছাড়া তার আর করার কিছু থাকে না। আজ আসার পর থেকেই মেয়েটির কোন তাড়া নাই দেখে একটু যেন অবাক লাগে সাদীর। পাশাপাশি বসে টিভি দেখতে দেখতে এক সময় সাদীর গায়ে হেলান দিয়ে বসে। একটা অন্যরকম ভাল লাগার অনুভূতিতে মন ভরে যায় সাদীর। মেয়েটির প্রতি মায়া লাগে। এতটুকু নড়াচড়া করতে মন চায় না তার। পাছে মেয়েটির মনের কোমল অনুভূতিটুকু ভেঙ্গে যায়। তখন সাদীর ইচ্ছে করে মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চুলে বিলি কাটে। সে মেয়েটির মাথায় হাত রাখে। তার চুলের একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগে। খুব আলতো করে সাদী জিজ্ঞাসা করল, চুলে কি তেল দিয়েছ? জবাকুসুম। কেন? বলল মেয়েটি। গন্ধটা মিষ্টি। মনে হয় বুকের ভেতর ঢুকে যায়। কথাটা শুনে মেয়েটা মৃদু হেসে তার দিকে চোখ তুলে বলল, তাই বুঝি? সাদীর মনে হয় মেয়েটি তাকে আর দশজন পুরুষের সঙ্গে এক করে ফেলেছে। আসলে সে যে অন্তর থেকে বলেছে, সেটি মেয়েটির বিশ্বাস হয় না। তার রাগ লাগে মেয়েটার ওপর। বলতে ইচ্ছে হয়, তোমরা বাজারের মেয়েরা, দুনিয়ার তাবৎ পুরুষকে এক ভাব। এত কঠিন কথাটা আর বলা হয় না। পাছে মেয়েটা রাগ করে চলে যায়। একটু গম্ভির হয়ে বলল শুধু, কেন বিশ্বাস হয় না আমার কথা? সাদীর মুখের ভাব দেখে মেয়েটা আাঁচ করে, তার কথায় সাহেব রাগ করেছেন? মৃদু হেসে মেয়েটি বলল, রাগ করেছেন আমার ওপর? তারপর মাথাটা এলিয়ে দিল সাদীর কোলের উপর। তারপর বলল, কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায়। কথাটা বলে, সাদীর কোলে দুচোখ বুঝে শুয়ে থাকে মেয়েটি। সাদীর মনে হয় মেয়েটি যেন তার পরিচিত রূপ ঝেড়ে ফেলে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সাদী তাকিয়ে দেখে মেয়েটির শ্যামলা মুখশ্রী, টানাটানা দুটি চোখ যেন স্বপ্নে বিভোর। তখন সাদীর কাছে মেয়েটি আর কেবল মেয়ে হয়ে থাকল না। সে যেন অরুনিমা হয়ে উঠেছে। সে আস্তে আস্তে মেয়েটির চুলে বিলি কাটে। বহুদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে গেল সাদীর। সেটা নিয়ে চুপচাপ ভাবতে ভাবতে অতীত তাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে তোলে। সাদী ভাবছে অতীতে একজন তাকে বিশ্বাস করতে পারে নাই। অথচ আজ মেয়েটি তার কথায় বিশ্বাস করতে চায়। দুই মেয়ের তুলনা করে তার কষ্ট লাগে। সে ভাবে, অতীতের মেয়েটির সঙ্গে আজকের মেয়েটির কোন মিল নাই। দশজনের সঙ্গে সময় কাটায় যে মেয়েটি সে তাকে বিশ্বাস করবে কোন যুক্তিতে? সেই হিসাব তার মেলে না। আর বিশ্বাস করল কি করল না সেটারও কোন অর্থ কি আছে তার কাছে? তারপরও তার মনে হয় চুলের গন্ধ নিয়ে সে যা বলেছে সত্যি সত্যি অনুভূতি থেকে বলেছে মেয়েটিকে। এতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। এই অকৃত্রিম অনুভূতিটা মেয়েটা বুঝতে চইল না প্রথম। তাই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আর মেজাজও চড়ে গিয়েছিল নিজের উপর। সে ভেবেছে, শুধু শুধু অপাত্রে জল ঢেলেছে। আর একটু পর, সেই অচেনা অজানা মেয়েটা যেন হয়ে উঠেছে আপনজন। অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই মেয়েটির মাথায় তার হাত থেমে যায়। মেয়েটির ভাবে, সাহেব এখনও রাগ করে আছেন। সে সাদীর মাথাটা টেনে নিয়ে দীর্ঘ একটা চুমো খায়। এতে যেন সাদীর মান ভাঙ্গে। আবার মেযেটির চুলে বিলি কাটে। এবার সাদীর মনে হয় মেয়েটির গায়ে যেন দোলন চাঁপার গন্ধ। এই মনের কথাটি আর মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু একটা রোমাঞ্চ তার মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে উঠে। সে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ ঘষে। আর আস্তে আস্তে দুজনেই সক্রিয় হয়ে বিছানায় উঠে আসে। সারা বিকেলজুড়ে বিছানায় কাটিয়ে মেয়েটি চলে গেলে সাদী আরও দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকে বিছনায়। ধীরে ধীরে তার জীবনের ব্যর্থতাগুলো এক দুই করে জমতে থাকে মনের পর্দায়। এক সময় তার মনে হয় তার আর করার মতো কিছুই নাই। তখনই মাথাটা তার ব্যথা করে উঠে। চারপাশ অসহ্য লাগে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অরনিমার কথা মনে পড়ে। তার মনে হয় যা হারিয়েছে তা আর ফিরে পাবার সম্ভাবনা নাই। তার মরা ছরায় আর বান ডাকবে না কোনদিন। দোলনচাঁপা তার প্রিয় ফুল। পরিণত বয়সে প্রায়ই মনে হতো তার ভালবাসার নারীর গায়ে সে দোলনচাঁপর গন্ধ পাবে। একদিন যাকে কাছে পেয়েছিল সেই অরুনিমার কথা মনে হলেই দোলনচাঁপার সুবাস ছাড়িয়ে পড়ে তার সারা অন্তরে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সে বুঝতে পারে এতক্ষণ যে মেয়েটার কথা ভাবছিল সেটা যেন ধরা দিয়েছে। তার মনে হয় অনুভূতি হল, অন্তর বিমোহিত করা একখানি অনিন্দ সুন্দর মুখশ্রী। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কথাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস সাদীর বুকচিরে বের হয় আসে। এক দিন অরুনিমাকে সে ভালবেসে ছিল। অরুণিমা তার ভালবাসার মূল্যে দেয় নাই। তাকে ছেড়ে গেল অবলীলায়। সেসব কথা মনে করে আজ সাদীর মন জুড়ে এই অনুভূতি প্রবল হয়ে ধরা দেয় যে, অরুনিমার কথা যে তাকে মনে করিয়ে দেয় তার কাছে সেই অরুনিমা। তাকেই সে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে। আর তখনই তার মনে পড়ে যায় নিজেকে উজাড় করে ধরা দেয়া মেয়েটির কথা। তার সারা অন্তরে তখন ভেসে বেড়াতে থাকে টানা টানা দুচোখের মেযেটার শ্যামলা মুখখানি। সাদীর মন উতলা হয়ে উঠে মেয়েটার জন্য। সাদী ভাবে কাল সে আসবে, নয়তো পরশু, অথবা অন্য কোনদিন। সাদী তার জন্য অপেক্ষা করবে অনন্তকাল।
×