‘ওর মতো একটা বেঈমান পোলার মরণ অইছে, তো কী ক্ষতি অইছে এই সমাজের? তোরা যা আমি ওর জানাজায় যামু না।’ সাতাশ বছরের এক তেজী তরুণ গলা ফাটিয়ে এভাবে যখন ক্ষোভ প্রকাশ করছিল তখন চারপাশের মানুষগুলো মাথা নেড়ে তার কথা সমর্থন করে। ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর এই স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন জাহিদ আকবর। এমন বাজে স্বপ্ন জীবনে আর কখনও দেখেননি তিনি। মাঝ রাতে দেখা এই স্বপ্ন জাহিদকে অস্থির করে তুলে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বিছানা থেকে উঠে মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়ির দক্ষিণ দিকের বেলকুনীতে রাখা টেনশন চেয়ারে বসলেন জাহিদ আকবর। অবশ্য পাশেই শুয়ে থাকা স্ত্রী টের পায়নি। ঘন কুয়াশার দাপটে আকাশের চাঁদটা ঝাপসা মনে হচ্ছে। পাশে একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ দুটি বুজে জাহিদ ভাবছিলেন এ কী দুঃস্বপ্ন দেখলাম! কাজটি সত্যি আমার ঠিক হয়নি। চরম এক অস্থিরতার দখলে জাহিদের পুরো শরীর-মন।
উত্তরার পাঁচতলা বাড়ির দোতলায় ওই ফ্ল্যাটটি কিনে স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন বেসরকারী একটি ব্যাংকের বড় কর্তা জাহিদ আকবর। যশ খ্যাতি আর বিত্তবৈভবের আধিপত্যে তিনি ভুলে গেছেন তার জন্ম ইতিহাস আর উপোস থাকা শৈশব। মা বাবা কি বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন? এ খবর রাখারও সময় নেই যেন! দুই ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে রাজধানীর একটি নামী স্কুলে। মাঝে মধ্যে বাবার কাছে ওরা জানতে চায় দাদা-দাদুর কথা। জাহিদ আকবর তখন অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে যায় ছেলেমেয়েকে। কড়া মেজাজের স্ত্রী দিলরুবাও চাকরি করেন নামকরা একটি শপিংমলের ম্যানেজার পোস্টে।
মাঝ রাতে জাহিদ স্বপ্নে দেখলেন- হার্ট স্ট্রোক করে তিনি মারা গেছেন। এ্যাম্বুল্যান্সে করে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শেরপুরের গ্রামের বাড়িতে। লাশের সঙ্গে তার দুই ছেলে মেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্ত্রী যাচ্ছে না। গ্রামের বাড়িতে দাফনের ব্যবস্থা করা হলো। জানাজায় শ’খানেক মানুষ হয়েছে। বাবা মার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হচ্ছে। স্বপ্নের মধ্যে জাহিদ দিব্যি শুনতে পেলেন এলাকার লোকজন বলে বেড়াচ্ছে একটা অকৃতজ্ঞের মৃত্যু হয়েছে। ওর মতো পোলার মৃত্যুতে এ সমাজের কী আর ক্ষতি হবে? টেনশন চেয়ারে বসে ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন নিয়ে ভাবছিলেন জাহিদ।
অনেক দিন ধরেই গ্রামের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। এমনকি বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাবা মার সঙ্গেও না। ইচ্ছে থাকলেও পারছেন না জাহিদ। কখনও অন্যের জমি বর্গা চাষ কখনও আবার শেরপুরের শ্রীবর্দীর মফস্বল শহরে রিকশা চালিয়ে একমাত্র ছেলেকে মানুষ করেছেন গোলাম সবুর। বাবা অসুস্থ থাকলে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ কখনও বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতেন তার মা। ছেলেকে পড়াশোনার খরচ জোগাতেন কত দিন যে অনাহারে কাটিয়েছেন গোলাম সবুর ও তার স্ত্রী। মেধাবী জাহিদ মা বাবার কষ্ট দেখে প্রায় বলতেন- আর ক’টা দিন! আমাদের কষ্ট আর থাকবে না। মা দেখো একদিন আমরাও সুখী হবো। খুব দরদমাখা কণ্ঠে বলতেন এমন সব কথা। জাহিদ আকবর এসএসসি ও এইচএসসি দুই পরীক্ষাতেই বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। এলাকার মানুষ মেধাবী জাহিদ নামেই চেনে তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরিতে যোগদান করেননি। একই সময় তার চাকরি হয় বেসরকারী একটি ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা পদে। তখন দিলরুবার সঙ্গে তার প্রেম চলছে। দিলরুবাই তাকে চাকরিতে যোগদানে বারণ করেছিল। প্রিয়তমার কথায় সেদিন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ না দিয়ে ব্যাংকে যোগ দেন। এরই ফাঁকে বিয়েটাও সেরে ফেলেন তারা। ঢাকার অভিজাত একটি কনভেনশন সেন্টারে বিয়ে হয় তাদের।
জাহিদের মা বাবাকে জানানো হয়নি। শ্বশুরবাড়ির ধনাঢ্য আত্মীয়স্বজনরা আসবে বিয়ে অনুষ্ঠানে, তাই গ্রামে থাকা জাহিদের হতদরিদ্র বাবা মাকে জানাতে দেয়নি দিলরুবা। তবে জাহিদ যে বিয়ে করছে এটা তারা জানেন। জাহিদ এখন দুই সন্তানের জনক এটা জানতেও বাকি নেই মা বাবার। বিয়ের পর অল্প কিছুদিন মা বাবার সঙ্গে টুকটাক যোগাযোগ ছিল। তারপর হঠাৎ করেই সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন জাহিদ। কিন্তু কেন? কী অভিমান? সে সমীকরণ মেলাতে পারছিলেন পরিচিত জনরা।
গোলাম সবুরের কেউ নেই আর। কুজো হয়ে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করেন। তার স্ত্রী সাফজান বেগম চোখের জ্যোতি হারিয়ে ফেলেছেন। শরীর জুড়ে বলিরেখা। বাড়িতেই থাকেন, যেতে পারেন না কোথাও। হাট বাজারে ভিক্ষা করার সময় গোলাম সবুরের এই করুণ পরিণতি দেখে লোকজন জানতে চান- তার ছেলের কথা। এলাকার সকলেই জানে জাহিদ আকবর ব্যাংকের বড় অফিসার। কিন্তু বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাবা মাকে কেন এখনও ভিক্ষা করতে হয়? সেই হিসাব মেলাতে পারেন না কেউ। বৃদ্ধ মানুষকে দেখে মায়া হয় সবার। কেউ খালি হাতে ফেরত দেয় না। কিন্তু মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না সবুর। কখনও কখনও নীরব থাকেন। গোলাম সবুরের গাল গড়িয়ে পড়া চোখের জল কারো কারো প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেয়। একবার তো বলেই ফেললেন- ‘ আমার জাহিদ মইরা গেছে। ওর কথা আমারে তোমরা জিগায়ো না তো। বহুদিন আগেই ওরে মাটি দিয়া রাখছি।’
ব্যাংকের কাজে জাহিদ আকবর দেশের বাইরে। স্ত্রী দিলরুবা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাসায়। ছুটি নিয়েছেন শপিং মল থেকে। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে মধ্যরাতের পর ফোন আসে। বেশ কয়েকবার ফোন বেজে উঠে। কিন্তু বিভোর ঘুমে থাকায় ফোন রিসিভ করতে পারেনি দিলরুবা। ভিক্ষা শেষে এক সন্ধ্যায় চাল ডাল নিয়ে বাড়ি ফিরলেন গোলাম সবুর। দুপুরে খাবার জুটেনি। স্ত্রী সাফজানও অনাহারে বৃদ্ধ স্বামীর প্রতীক্ষায় চেয়ে আছেন। বিকেল থেকেই সাফজানের শরীরটা খারাপ। কিন্তু প্রতিবেশী কারো কাছেই বলেননি। বুক ব্যথা। প্রচন্ড ব্যথা। সবুর বাড়ি ফেরার পরপরই হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকলেন সাফজান। বললেন, ‘আমারে তুমি মাফ কইরা দিও। আমি মনে অয় আর বাঁচুম না। আমার মরণের খবরটা আকবররে জানাইও না। ওর সময় নষ্ট অইবো। বাড়িতে আইয়া কান্নাকাটি করবো। তহন পাড়ার লোকজন আমার পোলাডারে গালাগাল করবো। কইবো- এতদিন মায়ের খোঁজ লও নাই, এহন আইছো চোখের পানি ফালাইতে। মাইনসের দেহাইতে। ও কষ্ট পাইবো।’
ক্রমশই সাফজানের অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। রান্নাবান্না বন্ধ। এবার প্রতিবেশী লোকজনকে ডেকে আনলেন গোলাম সবুর। সাফজান বিড়বিড় করে বললেন- ‘আকবরের বাপ, আমার মুখে একটু পানি দেও।’ কিন্তু গোলাম সবুর সে কথা শুনেননি। পাশে বসে প্রতিবেশী হালিমা খাতুন সাফজানের মুখে পানি দিলেন। এবার গোলাম সবুরকে কাছে ডেকে নিয়ে হালিম বললেন, ‘মিয়া বাই আফনেও একটু পানি দেন।’ সবুর চিনি মেশানো এক চামচ পানি স্ত্রীর মুখে দিলেন। তারপর...।
গোলাম সবুর ছাড়া বাড়িতে কান্নাকাটি করারও কেউ নেই। প্রতিবেশী নারী পুরুষের মধ্যে শোক ঘিরে আছে। কিন্তু কারো চোখে জল দেখা গেলো না। ঘড়ির কাঁটা তখন দুইটার ঘর ছুঁই ছুঁই। জাহিদ আকবরকে খবরটা দেওয়ার জন্য প্রতিবেশীরা অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু কারো কাছে তার নতুন নাম্বারটা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রতিবেশী আরমান তখন ওই ব্যাংকের নোট বুক বের করে জাহিদের নাম্বার খুঁজে পেলেন। কিন্তু সেটা বন্ধ। জাহিদ তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এবার দিলরুবা যে শপিংমলে চাকরি করেন সেই শপিংমলের নাম্বার সংগ্রহ করলেন গুগল থেকে। ফোন দিলেন দিলরুবাকে। কিন্তু তিনি তখন গভীর ঘুমে। ফোন রিসিভ হলো না। সাফজানের মৃত্যুর খবর দিতে পারলেন না ছেলে কিংবা ছেলের বউকে।
পরদিন সকালে সাফজানের জানাজা। উপস্থিত মুসল্লিরা সাফজানের লাশ সামনে নিয়ে ধিক্কার জানালো জাহিদ আকবরকে। কারো পেটে যেন এমন অকৃতজ্ঞ সন্তানের জন্ম না হয়-এমন কথাও বললেন কেউ কেউ। সঙ্গীকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়লেন গোলাম সবুর। গ্রামবাসীকে বললেন- ‘আমি বিষ খাইয়া মইরা যাই- তোমরা আমারে ওর সাথেই মাটি দিয়া থও।’ সান্ত¦না দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন গ্রামের লোকজন।
তেলে চিঁটচিঁটে বিছানায় শুয়ে কান্নাকাটি করতে করতেই সবুরের দিন যায় রাত আসে। হাড্ডিসার শরীর একা নাড়াতেই কষ্ট হয় সবুরের। কিন্তু উপায় নেই। প্রতিবেশিরাই আর কত দেখভাল করবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আরমান মাস দুই পর বাড়ি এসেছেন ছুটিতে। গোলাম সবুরের খোঁজ নিতে ওই বাড়িতে গেলেন তিনি। সবুরের অবস্থা দেখে ভেতরে নাড়া দিয়ে উঠলো আরমানের। এলাকার দু’চারজনকে ডেকে আনলেন। বললেন- ‘এভাবে তো একটা মানুষকে মরতে দেওয়া যায় না। সবুর চাচাকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি। সেখানে চাচা ভালো থাকবেন।’ আরমানের প্রস্তাবকে সকলেই সমর্থন দিলেন। সবুরকে ওই দিনই মণিপুর বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে গেলেন আরমান। কর্তৃপক্ষের কাছে রেখে চলে এলেন তিনি। আরমান চলের সময় তার পেছনের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন সবুর।
বৃদ্ধাশ্রমে কাটছে গোলাম সবুরের জীবনের শেষ দিনগুলো। আশ্রমের সেবায় কিছুটা সুস্থও হয়ে উঠলেন। ফজরের নামাজ শেষে হাঁটতে বের হন। আশ্রমে থাকা তার মতো অভাগাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে দিন কেটে যায়। কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা ভুলতে পারেন না এক মুহূর্তের জন্যও। ছেলের কথাও মনে পড়ে। ভাগ্যকে দোষ দিয়ে সান্ত¦না খুঁজে ফেরেন। জাহিদ আকবরের ঘরে জন্ম নেওয়া দুই ছেলেমেয়েকে কখনও দেখেননি সবুর। তবুও নাতি-নাতনি দু’জন তার কল্পনায় আসে নানাভাবে। তার আঙুল ধরে সেজেগুজে নাতি-নাতিন স্কুলে যাচ্ছেন, সন্ধ্যা বেলায় তাদের জন্য বাদাম, চানাচুর কিনে বাড়ি ফিরছেন- এমন নানা কল্পনা। তখন আর নিজেকে সামলে নিতে পারেন না। স্ত্রীর কবরটি দেখার জন্য মাঝে মধ্যে ছটফট করে সবুর। কিন্তু কোনো উপায় নেই। দু’এক মাস পরপর আশ্রমের দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়কের কাছে ফোন করে খোঁজ খবর নেন আরমান।
বাবা বৃদ্ধাশ্রমে, মা প্রয়াত হয়েছেন তাও বছর হতে চললো। জাহিদ আকবরের কাছে সে খবরও নেই। কী এক ঘোরের মধ্যে আটকে আছেন জাহিদ। মা বাবার খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেন না তিনি। জাহিদের অভিমানটা নিজের সঙ্গেই। বিয়ের সময় বাবা মাকে জানাতে পারেননি বলে নিজের সঙ্গেই রাগ করেছেন। কোনো দিন আর মা বাবাকে মুখ দেখাবেন না- কথা বলবেন না- প্রতিজ্ঞা করেছেন। যে মা বাবা এতো কষ্ট করে জাহিদকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, মানুষ করেছেন সেই বাবা মাকে নিজের বিয়েতে আনতে না পারার অক্ষমতা থেকেই এমন অভিমান জমা হয়েছে বুকের ভেতর। জাহিদের বুকে জিইয়ে রাখা এই কষ্টের কথা কেউ জানে না।
গোলগাল চেহারা। আনিকাকে দেখতে অনেকটা জাহিদের মায়ের মতো। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। শীত মৌসুম শুরু হয়েছে। আনিকার স্কুল থেকে বার্ষিক বনভোজনের আয়োজন করা হলো। মণিপুর বৃদ্ধাশ্রমের পাশেই গজারী বনে তাদের বনভোজন। দশ বারোটা বাসে করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের পাশেই বনভোজনে গেলেন শিক্ষকরা। হইচই-খেলাধুলা চলছে বনের ভেতরে খালি মাঠে। সাত আট জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বকুল স্যার বের হলেন। বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখাবেন তার প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের। আনিকা অত্যন্ত মেধাবী। নাচ গান কবিতা-সবই পারে সে। হাতের লেখাও চমৎকার। এ কারণে শিক্ষকদের প্রিয় হয়ে উঠেছে ছোট্ট আনিকা। বকুল স্যারের সঙ্গে আশ্রমে গেলো আনিকা। ফুল-ফলের বাগান, পুকুর, শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা কবরস্থান আর মসজিদ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন বকুল স্যার। ডান দিকে মহিলাদের আশ্রম-বাঁ দিকে পুরুষ। মহিলা আশ্রম দেখে শেষ করে এবার বাঁ দিকে হাঁটছেন তারা। বকুল স্যার সামনে- পেছনে তার ছাত্রছাত্রীরা। নিচ তলায় থাকা প্রবীণদের দেখে তারা দ্বিতীয় তলায় উঠছেন। আনিকা সবার পেছনে। এ সময় সিঁড়ি দিয়ে একজন প্রবীণ লাঠি ভর দিয়ে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে আসছেন। সবাই ওপরে উঠে গেছে কিন্তু আনিকার জুতা পা থেকে খসে এক সিঁড়ি নিচে পড়ে যায়। লাঠি ভর করে করে নেমে আসা প্রবীণ ব্যক্তিটি তখন আনিকার সামনে। শিশুটিকে দেখে প্রবীণ বলে উঠলেন- কী গো মা! কী অইছে তোমার! না আঙ্কেল কিছু হয়নি- জুতা পড়ে গেছে। তখনও বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকায়নি আনিকা। সে জুতা হাতে নিয়ে পায়ে পড়ছে।
: মা তোমরা কী এই আশ্রম দেখতে আইছো? ভালো লাগতাছে?
: হ্যাঁ আঙ্কেল, তবে আপনাদের দেখে খারাপ লাগছে।
: ক্যান মা! খারাপ লাগছে ক্যান?
: না, পরিবারের সবাইকে বাসায় রেখে আপনারা এখানে থাকেন। আমারও দাদা দাদু আছে, তারা বাড়িতে থাকে। তাদেরকে আমি এখনও দেখিনি। বাবার কাছে দাদা-দাদুর কথা জানতে চাইলে বলেন তারা ভালো আছে। এবার বাসায় গিয়ে বাবাকে বলবো- গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েই দু’জনের কথা হচ্ছে। আশ্রমে ঠাঁই হওয়া প্রবীণ শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছোট্ট মেয়েটির কথা শুনে খসখসে গাল গড়িয়ে বৃদ্ধের চোখ দেখে জল পড়ছে। কল্পনায় দেখছেন দুই নাতি-নাতিনকে। পুত্রের কথাও মনে পড়ে যায়।
: আঙ্কেল আপনি কাঁদছেন কেন?
: আমারও দু’জন নাতি-নাতিন আছে, অগরে দেহার সুযোগ আমার অয় নাই। কপাল খারাপরে মা - কপাল খারাপ।
: আঙ্কেল- আপনার বাড়ি কোথায়? আপনাকে লালন পালন করার মতো কেউ নেই?
: আমার বাড়ি শেরপুরে। শ্রীবর্দী থানায়। আছে একটা পোলা আছে। ও নাকি ব্যাংকে চাকরি করে। পোলাডার নাম জাহিদ আকবর।
: কী বলেন? আমার বাবার নামও তো জাহিদ আকবর। ব্যাংকে চাকরি করে। শুনেছি আমাদের গ্রামের বাড়ি শেরপুরের শ্রীবর্দীতে। আমার দাদার নাম গোলাম সবুর। বাবা বলছে- দাদির নাম সাফজান। দাদার আর কোন সন্তান নেই। আমার বাবা একই।
: আয় আয় দাদু আমার বুকে আয়। আমারে ধর। আমি আর পারতাছি না। হায় আল্লাহ! আমার আপনজন খুঁইজা পাইছি। তুই আমার জাহিদের মেয়ে। আমার নাতিন।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েই গোলাম সবুর বুকে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। আশ্রমের লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই বকুল স্যার ও তার সহপাঠীরা সিঁড়িতে এসে এই দৃশ্য দেখতে পান। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তারা। কান্নার শব্দ পেয়ে দোতলা থেকে নেমে আসেন তত্ত্বাবধায়ক আহমেদ রাজু। এবার পুরো ঘটনা খুলে বলেন গোলাম সবুর। আনিকার কান্না থামছিলই না। শিক্ষক ও সহপাঠীদের সামনে বিব্রতও হচ্ছিল মেয়েটি। ছোট হলে কী হবে- এটুকু বোধ তার মধ্যে আছে। অফিস কক্ষে নিয়ে সকলকে বসতে দিলেন আহমেদ রাজু। এবার বকুল স্যারের মোবাইল থেকে আনিকা ওর বাবাকে ফোন করলেন। ওপাশ থেকে আনিকার ভারি কণ্ঠ শুনে ভয় পেয়ে গেলেন জাহিদ আকবর। তখন তিনি ব্যাংকের জরুরী একটি মিটিংএ ছিলেন। কান্না করতে করতে জাহিদ আকবরকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। জাহিদও নিশ্চিত হলেন- বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ওই মানুষটি তার বাবা। ঠিক আছে মা তুমি রাখো- আমি আসছি। মিটিং শেষ করে জাহিদ দ্রুত গতিতে মণিপুর আশ্রমের দিকে আসতে থাকলেন। ততক্ষণে বনভোজনের খাওয়া দাওয়া শেষ পর্যায়ে। আশ্রমের অফিস কক্ষের চেয়ারে বসে থাকা গোলাম সবুরের কোলে আনিকা। নানা ভাবে আদর করছেন আর চোখ মুছছেন তিনি। আনিকাও দাদাকে পেয়ে আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না। বকুল স্যারের মোবাইলে মাকেও জানায় আনিকা। ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেছে। চেয়ারা বসা গোলাম সবুর বললেন- ‘আমারে তোমরা ধরো, আমি চাইল্যা যাইতাছি।’ মুহূর্তের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে যায় গোলাম সবুরের পুরো দেহ। তাড়াতাড়ি আশ্রমের ডাক্তার আনা হয়। ডাক্তার বললেন ‘সরি’। জাহিদ আকবর এখনো পৌঁছেনি আশ্রমে। আনিকার কান্না থামানো চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন বকুল স্যার।