
সংগৃহীত প্রতীকী ছবি
মা—এই শব্দটির মাঝেই যেন লুকিয়ে থাকে পুরো পৃথিবীর মমতা, স্নেহ আর ভালোবাসা। একজন সন্তান বড় হয়ে ওঠে মায়ের আদর, স্নেহ আর ভালোবাসার ছায়ায়। তাই মায়ের মৃত্যু একজন সন্তানের জীবনে যে শূন্যতা তৈরি করে, তা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।
আমার জীবনেও সেই শূন্যতার অধ্যায় শুরু হয় ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।
আমার মা, নিহার বেগম, বিক্রমপুরের এক সাধারণ ঘরের মেয়ে হলেও ছিলেন অসম্ভব প্রাণবন্ত ও পরিশ্রমী। মেরুদণ্ডে স্পাইনাল টিউমার ধরা পড়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য সার্জারির প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু অপারেশনের মাত্র দুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসকেরা সার্জারি স্থগিত রেখে বাসায় রেখে সেবা-শুশ্রূষার পরামর্শ দেন।
আমি নিজের সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে মায়ের সেবায় রাত-দিন এক করে দিই। কিন্তু সব চেষ্টার পরও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—সেই ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ভোর ৫টা ২০ মিনিটে মা চিরবিদায় নেন।
আজও মায়ের চলে যাওয়ার শূন্যতা আমার মনে তীব্র হয়ে বাজে। মাকে ছাড়া দেখতে দেখতে তিন বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আজও তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি।
বিশেষ করে ঈদের দিনগুলোয় মায়ের অভাব আরও বেশি অনুভূত হয়। মা ছিলেন অসাধারণ রাঁধুনি। তাঁর হাতে তৈরি বিক্রমপুরের বিখ্যাত ‘আলুর বউয়া’-এর স্বাদ যেন আজও জিহ্বায় লেগে আছে। সেই স্বাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মায়ের স্নেহ আর ভালোবাসার অসংখ্য স্মৃতি, যা কোনোদিনই ভোলার নয়।
ঈদের সকালে মায়ের হাতে বানানো সেমাই, পোলাও, রোস্ট, পিঠা—এসব ছাড়া ঈদের আনন্দ কখনোই পূর্ণ হতো না। মা চলে যাওয়ার পর বহু ঈদ সকালে বাজারের কোনো হোটেলে গিয়ে রুটি-ভাজি খেয়ে দিন শুরু করেছি। কিন্তু সেই রুটি-ভাজি কি আর মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ ফিরিয়ে দিতে পারে?
মায়ের চলে যাওয়ার পর শুধু যে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেছে তাই নয়, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কেও নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। মায়ের মৃত্যুর পরে আমাদের পরিবারের খোঁজ কেউ রাখেনি। বেঁচে আছি কি না, কেমন আছি—জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি কেউ।
মায়ের বাবার বাড়ির ওয়ারিশ সম্পত্তিতে মায়ের নাম ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখান থেকেও নানা রকম ফন্দি করে মায়ের নাম অবৈধভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে মায়ের হক থেকে। এতিম সন্তানের এই ক্ষোভ, এই বঞ্চনার বিচার আমরা কাকে দেব? যারা এতিমদের হক নষ্ট করে, তাদের কি কোনো বিচার হবে না?
আমাদের পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত। জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে মা আমাদের গড়ে তুলেছেন। ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আমরা সকলে একসাথে এগোচ্ছিলাম। সেই পরিশ্রমের ফল যখন আসতে শুরু করল, তখনই সুখের মুখ না দেখেই মা পাড়ি জমালেন ওপারে। এ যেন জীবনের সুখের বিনিময়ে কেনা এক গভীর দুঃখ!
আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় মা পাশের ঘরে আছেন। তাঁর ডাকে হয়তো আবার একবার জেগে উঠব। বাস্তব বড় নির্মম—এই ডাকের সাড়া আজ আর আসে না।
এই লেখা শুধু আমার মাকে নিয়ে নয়—প্রত্যেক সেই সন্তানের জন্য, যারা মাকে হারিয়েছে। ঈদের আনন্দ, জীবনের সুখ—কোনো কিছুই মা ছাড়া আর পূর্ণতা পায় না।
মা, খুব মনে পড়ছে। সকালগুলো আজও তোমার অভাব অনুভব করিয়ে দেয়। তুমি ছাড়া কোনো উৎসবই আর কখনোই আগের মতো হয়ে উঠবে না। ইতি, তোমার অভাগা সন্তান।
সাব্বির