ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

ছোট গল্প: ফিরে আসা স্রোত

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৯:০৪, ২৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৯:১৬, ২৩ জুন ২০২৫

ছোট গল্প: ফিরে আসা স্রোত

ছবিঃ সংগৃহীত

শতবর্ষের পুরনো বট গাছটির ছায়ায় বসে রূপালী সূর্যোদয়ের আলোয় চিকচিক করা জলের দিকে তাকিয়ে থাকত মানিক। তার দাদুর কাছ থেকে শোনা সেই পুরনো কাহিনী - কীভাবে একদিন এই নদীর জল এত স্বচ্ছ ছিল যে তলদেশের নুড়ি পাথর দেখা যেত। মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে খেলা করত, পদ্মফুল ফুটত পানির উপর, আর গ্রামের মানুষ এই জলেই গোসল করত, রান্নার জল নিত।

কিন্তু আজ? মানিকের চোখের সামনে যে দৃশ্য, তা যেন অন্য কোনো গল্পের। কালো, দুর্গন্ধযুক্ত জল। পানির উপর ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের ব্যাগ, আর নানা রকমের আবর্জনা। দূরে কারখানার চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া আকাশকে ধূসর করে তুলেছে।

মানিক আজ ত্রিশ বছর বয়সী একজন পরিবেশবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছে কয়েক মাস হলো। উদ্দেশ্য একটাই - এই মরে যাওয়া নদীকে আবার বাঁচিয়ে তোলা।

একদিন সকালে নদীর পাশ দিয়ে হাঁটার সময় সে দেখে কারখানার পাইপ দিয়ে গড়গড় করে কালো রঙের তরল পদার্থ পড়ছে নদীতে। মানিক জানে, এটা চামড়া তৈরির কারখানার বর্জ্য। ক্রোমিয়াম, সিসা, পারদের মতো ভারী ধাতু মিশে আছে এই জলে।

"ও মানিক ভাই!" পেছন থেকে ডাক শুনে ঘুরে তাকাল মানিক। দেখল তার বন্ধু করিম দৌড়ে আসছে। করিম গ্রামের মৎস্যজীবী। বংশানুক্রমে মাছ ধরেই সংসার চালিয়েছে তার পরিবার।

"আরে করিম, কি খবর?"

"খবর আর কি হবে ভাই। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে। গতকাল সারারাত জাল ফেলে রেখেছিলাম, একটা মাছও পাইনি। যেগুলো পেয়েছি, সেগুলোর গায়ে পচন ধরেছে। খাওয়ার মতো নয়।" করিমের গলায় হতাশা।

মানিক জানে এই সমস্যার গভীরতা। শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, শহরের নর্দমার জল, কৃষি জমির সার আর কীটনাশক - সব মিলে নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। ফলে মাছ বাঁচতে পারছে না।

"করিম, তুমি কি আমার সাথে কাজ করবে? আমরা মিলে এই নদীকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।"

করিমের চোখে আশার আলো ফুটে উঠল। "অবশ্যই ভাই। কিন্তু কিভাবে? বড় বড় কারখানার মালিকদের সাথে আমাদের পারার কথা নয়।"

"দেখো করিম, একা হয়তো পারব না। কিন্তু গ্রামের সবাই মিলে চেষ্টা করলে অসম্ভব কিছুই নয়।"

এরই মধ্যে তাদের কাছে এসে পড়ল রশিদা খালা। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। তিনি গ্রামের মহিলা সমিতির সভানেত্রী।

"মানিক বাবা, তুমি ভালো করেছ গ্রামে ফিরে এসে। আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই নদীর যে অবস্থা হয়েছে, তাতে আমাদের বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।"

"কি রকম অসুখ খালা?"

"চর্মরোগ, পেটের অসুখ, শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার বলেছে, দূষিত পানির কারণেই এসব হচ্ছে। আগে তো আমরা এই নদীর পানিই খেতাম। এখন কুয়ার পানিও নিরাপদ নয়। নদীর দূষণ মাটির নিচের পানিতেও পৌঁছে গেছে।"

মানিক বুঝল, সমস্যা তার ভাবনার চেয়েও গভীর। কেবল নদী নয়, পুরো এলাকার পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে।

সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের স্কুলের উঠানে একটা সভার আয়োজন করল মানিক। শিক্ষক, কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ী - সবার কাছ থেকে মানুষ এসেছে। এমনকি কয়েকজন কারখানার শ্রমিকও উপস্থিত।

"বন্ধুরা," মানিক শুরু করল, "আমরা সবাই জানি আমাদের নদীর অবস্থা কেমন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমরা চাইলে এই নদীকে আবার সুস্থ করে তুলতে পারি।"

সভায় উপস্থিত হাসান মিয়া, যিনি পাশের কারখানার শ্রমিক, হাত তুলে বললেন, "মানিক ভাই, আমরাও চাই নদী পরিষ্কার হোক। কিন্তু মালিক সাহেব বলেন, বর্জ্য পরিশোধনের প্লান্ট বসাতে অনেক টাকা লাগবে। তাহলে কারখানা লাভজনক হবে না।"

"হাসান ভাই," মানিক উত্তর দিল, "এটা একটা ভুল ধারণা। আসলে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ সংরক্ষণ করা বেশি লাভজনক। ক্লিনার প্রোডাকশন পদ্ধতি ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ কমে, বর্জ্যও কমে।"

গ্রামের স্কুল শিক্ষক আলতাফ স্যার বললেন, "মানিক, তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু শুধু কথা বললে তো হবে না। আমাদের কংক্রিট পরিকল্পনা দরকার।"

"অবশ্যই স্যার। আমি একটা তিন পর্যায়ের পরিকল্পনা করেছি। প্রথমে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরাসরি পরিষ্কারের কাজ শুরু করব। আর তৃতীয়ত, আইনি এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেব।"

সভায় সবাই মানিকের প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরের দিন থেকেই কাজ শুরু।

প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রশিদা খালার নেতৃত্বে মহিলারা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করল। তারা মানুষকে বোঝাতে লাগল কেন নদীতে আবর্জনা ফেলা যাবে না, কেমন করে ঘরের বর্জ্য আলাদা করতে হবে।

করিম এবং অন্যান্য জেলেরা নৌকা দিয়ে নদী থেকে প্লাস্টিক, পলিথিন তোলার কাজ শুরু করল। প্রথম দিনেই তারা প্রায় পাঁচ ট্রাক আবর্জনা তুলল।

স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আলতাফ স্যারের সাথে মিলে 'নদী রক্ষা অভিযান' নামে একটা ক্যাম্পেইন শুরু করল। তারা পোস্টার বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় লাগাতে লাগল, নাটকের মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে লাগল।

কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ ছিল কারখানাগুলোর বর্জ্য বন্ধ করা। মানিক জানত, এটা সহজ কাজ নয়।

একদিন মানিক গেল সবচেয়ে বড় ট্যানারির মালিক হাজী সাহেবের কাছে। হাজী সাহেব এই এলাকার একজন ধনী ব্যবসায়ী।

"হাজী সাহেব, আমি আপনার সাথে নদী দূষণ নিয়ে কথা বলতে এসেছি।"

"আরে মানিক বাবা, তুমি তো শুনি বেশ নাম করেছ গ্রামে। কিন্তু দেখো বাবা, ব্যবসা মানে ব্যবসা। আমি চাইলেই তো আর বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট বসাতে পারি না। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ।"

"হাজী সাহেব, আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একটা নতুন প্রকল্প আছে। যে কারখানা বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট বসাবে, তাকে লোন দেওয়া হবে কম সুদে। এছাড়া ট্যাক্স রেবেটও পাবেন।"

হাজী সাহেব আগ্রহ দেখালেন। "সেটা ভালো কথা। কিন্তু প্রযুক্তিগত বিষয়ে আমি কিছু জানি না।"

"সেটার ব্যবস্থা আমি করে দেব। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ আছে। তারা সাহায্য করবেন।"

এইভাবে ধীরে ধীরে মানিক একের পর এক কারখানার মালিকদের বোঝাতে থাকল। কেউ কেউ রাজি হলো, কেউ কেউ টালবাহানা করতে লাগল।

তিন মাস পর গ্রামের মানুষ প্রথম ইতিবাচক ফল দেখতে পেল। নদীর পানির রং একটু পরিষ্কার হয়ে এসেছে। দুর্গন্ধ কমেছে। কয়েকটা ছোট মাছও দেখা গেছে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় বাধা এলো যখন একটা বড় টেক্সটাইল কোম্পানির মালিক রহমান সাহেব মানিকদের বিরোধিতা শুরু করলেন। তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য নিয়ে চাপ দিতে লাগলেন।

একদিন রাতে মানিকের বাড়িতে ফোন এলো। গলার স্বর চেনা যাচ্ছে না।

"মানিক, তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছ। নদী নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার নেই। চুপচাপ থাক, নইলে ভালো হবে না।"

মানিক বুঝল, তার কাজ ফলপ্রসূ হচ্ছে বলেই এই ধরনের হুমকি আসছে। তবে সে ভয় পেল না। বরং এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল।

পরের দিন গ্রামে আবার সভা ডাকল মানিক। এবার আরো বেশি মানুষ এসেছে। পাশের দুটো গ্রামের মানুষও এসেছে।

"বন্ধুরা," মানিক বলল, "আমাদের কাজে কিছু মানুষ অসন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আমাদের চুপ করিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমরা কি থামব?"

"না!" সমস্বরে চিৎকার করে উঠল সবাই।

রশিদা খালা উঠে দাঁড়াল। "মানিক বাবা, আমাদের বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমরা তোমার সাথে আছি। যা দরকার করব।"

আলতাফ স্যার বললেন, "আমরা আইনি পথে এগোবো। জেলা প্রশাসক এবং পরিবেশ আদালতে নালিশ করব।"

এরই মধ্যে অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটল। ঢাকা থেকে একজন সাংবাদিক এসেছেন এলাকায়। তার নাম সুমিত্রা রায়। তিনি পরিবেশ বিষয়ে লেখালেখি করেন।

"আমি আপনাদের কাজের কথা শুনেছি," সুমিত্রা বললেন মানিকের সাথে দেখা করে। "এটা নিয়ে একটা বড় রিপোর্ট করতে চাই। জাতীয় পর্যায়ে এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।"

মানিক খুশি হলো। জাতীয় গণমাধ্যমে এলে সরকারি পর্যায়ে নজর আসবে।

সুমিত্রা তিন দিন থেকে পুরো এলাকা ঘুরে দেখলেন। কারখানাগুলোর অবস্থা, নদীর দূষণের মাত্রা, মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা - সবকিছুর উপর বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করলেন।

একসপ্তাহ পর জাতীয় দৈনিকে বেরিয়ে গেল বড় রিপোর্ট। শিরোনাম ছিল: "মরে যাওয়া নদীকে বাঁচানোর লড়াই: এক গ্রামের অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনী।"

রিপোর্ট প্রকাশের পর অনেক কিছু বদলে গেল। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা টিম এসে তদন্ত শুরু করল। কয়েকটা কারখানাকে নোটিশ দেওয়া হলো। বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট না বসালে বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হলো।

এদিকে মানিকদের কাজও এগিয়ে চলল। গ্রামের মানুষ এখন আর নদীতে কোনো আবর্জনা ফেলে না। একটা কমিউনিটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু হয়েছে। জৈব বর্জ্য দিয়ে কম্পোস্ট সার বানানো হচ্ছে। প্লাস্টিক সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করা হচ্ছে।

ছয় মাস পর একটা ছোট অলৌকিক ঘটনা ঘটল। করিম একদিন সকালে দৌড়ে এলো মানিকের কাছে।

"মানিক ভাই! মানিক ভাই! আজ রুই মাছের একটা ঝাঁক দেখলাম নদীতে!"

মানিক প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না। রুই মাছ বেঁচে থাকতে পারে মানে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়েছে।

নদীর ধারে গিয়ে মানিক নিজেই দেখল। সত্যিই! পানিতে মাছ খেলা করছে। এত দিন পর!

এই খবর গ্রামে ছড়িয়ে গেল বিদ্যুতের মতো। মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ল। অনেকেই কেঁদে ফেলল আবেগে।

কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি। কয়েকটা কারখানা এখনো বর্জ্য ফেলছে। কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে হবে। জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে।

এক বছর পর পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। নদীর পানি এখন মোটামুটি পরিষ্কার। মাছের ঝাঁক দেখা যায় প্রায়ই। পাখিরাও ফিরে এসেছে। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা কমেছে।

হাজী সাহেব এখন বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট বসিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বুঝতে পেরেছেন যে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন আসলে বেশি লাভজনক। তার কারখানার উৎপাদিত চামড়া এখন ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে ভালো দামে, কারণ সেখানে পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বেশি।

রহমান সাহেবের টেক্সটাইল কারখানাও শেষ পর্যন্ত নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হয়েছে। সরকারি চাপে তাকে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা চালু করতে হয়েছে।

আজ দুই বছর পর মানিক আবার সেই বট গাছের নিচে বসে আছে। কিন্তু এবার একা নয়। তার সাথে আছে তার স্ত্রী অনিমা। অনিমাও পরিবেশবিদ। তাদের বিয়ে হয়েছে ছয় মাস আগে।

"দেখো অনিমা," মানিক বলল, "এই নদীর পানিতে এখন সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। দুই বছর আগে এটা ছিল কালো নর্দমার মতো।"

অনিমা মুচকি হেসে বলল, "তুমি যে কত কষ্ট করেছ এই নদীকে বাঁচাতে। কিন্তু এটাই তো আসল সার্থকতা।"

এমন সময় করিম এসে হাজির। তার হাতে একটা বড় রুই মাছ।

"মানিক ভাই, দেখো! আজকে কি সুন্দর মাছ ধরেছি! আর স্বাদও আগের মতো। এখন আর পচা গন্ধ নেই।"

মানিক হাসল। "করিম, এটা শুধু তোমার একার সাফল্য নয়। পুরো গ্রামের মানুষের সাফল্য।"

"হ্যাঁ ভাই। এখন আমার ছেলেও মাছ ধরার কাজ শিখছে। আগে তো ভয় পেতাম, এই নদীতে কি আর মাছ থাকবে? এখন নিশ্চিন্ত।"

সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। নদীর পানিতে সোনালি আলোর খেলা। দূর থেকে ভেসে আসছে গ্রামের বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ। তারা নদীর ধারে খেলছে। আগে যেটা ছিল নিষিদ্ধ, এখন সেটাই তাদের আনন্দের জায়গা।

রশিদা খালা এসে বসলেন তাদের পাশে। "মানিক বাবা, আমার নাতনি গতকাল বলল, দাদিমা, আমি বড় হয়ে মানিক কাকার মতো নদী বাঁচাবো।"

এই কথা শুনে মানিকের চোখে পানি এসে গেল। সত্যিই, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

"খালা, আমরা যে কাজ শুরু করেছিলাম, সেটা এখনো শেষ হয়নি। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে।"

আলতাফ স্যারও এসে যোগ দিলেন। "মানিক, তুমি জানো, আমাদের স্কুলে এখন পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়টা অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। বাচ্চারা নদী, বন, বন্যপ্রাণী নিয়ে পড়তে ভালোবাসে।"

"এটাই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল স্যার। শুধু নদী পরিষ্কার করা নয়, মানুষের মনও পরিষ্কার করা।"

রাত গভীর হয়ে আসছে। একে একে সবাই বাড়ি ফিরে গেল। মানিক আর অনিমা রয়ে গেল একা।

"মানিক," অনিমা বলল, "আমি গর্বিত যে তোমাকে বিয়ে করেছি। তুমি শুধু একজন পরিবেশবিদ নও, তুমি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা।"

"অনিমা, এই স্বপ্ন শুধু আমার নয়। এই গ্রামের প্রতিটা মানুষের। আমরা প্রমাণ করেছি যে অসম্ভব বলে কিছু নেই।"

তারা হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। পেছনে রয়ে গেল প্রবাহমান নদী। যে নদী একদিন মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছেছিল, আজ সে আবার জীবন্ত। কলকল শব্দে বয়ে চলেছে।

এই কাহিনী শুধু একটা নদীর পুনরুজ্জীবনের গল্প নয়। এটা মানুষের ইচ্ছাশক্তি আর একাগ্রতার গল্প। এটা প্রমাণ করে যে যখন একটা সমাজ একসাথে কোনো লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়, তখন যে কোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।

আজকে যে নদী আবার প্রাণবন্ত, সেখানে কাল আবার মাছেরা ঝাঁক বেঁধে খেলবে। পরশু হয়তো পদ্মফুল ফুটবে। আর তার পরের দিন? হয়তো নতুন প্রজন্মের কোনো বাচ্চা এই নদীর ধারে বসে স্বপ্ন দেখবে আরো সুন্দর একটা পৃথিবীর।

মানিকের এই সংগ্রাম এখানেই শেষ নয়। এটা একটা শুরু মাত্র। কারণ প্রকৃতিকে বাঁচানোর লড়াই কখনো শেষ হয় না। এটা প্রতিদিনের সংগ্রাম। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব।

এবং সেই রাতে, যখন পূর্ণিমার আলোয় নদীর পানি চকচক করছিল, তখন মনে হচ্ছিল যেন নদী নিজেই কৃতজ্ঞতায় মুখর হয়ে উঠেছে। তার স্রোতের আওয়াজে ছিল একটা নতুন সুর - আশার সুর, জীবনের সুর।

 

আলীম

×