ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

অদম্য তামান্নার সফলতার গল্প

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ০১:৪৮, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

অদম্য তামান্নার সফলতার গল্প

এক পায়ে যুদ্ধ জয় করা অদম্য তামান্নার লেখা বই ‘ইচ্ছার আলো’ প্রকাশিত হয়েছে

এক পায়ে যুদ্ধ জয় করা অদম্য তামান্নার লেখা বই ‘ইচ্ছার আলো’ প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি তিনি নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করেন। বইটিতে তার জন্মের পর থেকে সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়েছে। তামান্না যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুরের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পী দম্পতির সন্তান। 
জন্ম থেকেই দুই হাত ও একটি পা নেই তামান্নার। সব বাধা পেরিয়ে বাঁ পা দিয়ে লিখে তামান্না মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবনের সকল পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। একই সঙ্গে শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে পড়ছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে পা দিয়ে তামান্না বিশ^ জয় করার স্বপ্ন দেখছিলেন; সেই পা দিয়ে এবার তিনি বই লিখেছেন।
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তামান্না মেধা, সংগ্রাম আর বুদ্ধিদীপ্ত কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন অনেক সুস্থ মানুষের ওপর। হাজারও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মেধা ও সৃজনশীল কাজে অনেকের অনুপ্রেরণার উৎস তিনি। এমনি ধৈর্যশক্তি ও অধ্যবসায়ের বাস্তব দৃষ্টান্তও তামান্না আক্তার নুরা। 
তামান্না আক্তার নুরা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমার প্রথম লেখা বই ‘ইচ্ছার আলো’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘বইটি অনুপ্রেরণামূলক বই।’ এই বইটি লেখা ছিল আমার একটি স্বপ্ন। শারীরিক অক্ষমতা কখনো স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে পারে না। এটি আমি পাঠকদের মনেপ্রাণে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। অবশেষে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। 
তিনি আরও জানান, আমি গত বছর যখন ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যখন বাড়িতে বসেছিলাম; তখন বই লেখার পরিকল্পনা নিই। ভাবি আমার জীবন ও একটি প্রতিবন্ধী মেয়ের উপর বইটি লিখলে সবশ্রেণি-পেশার মানুষ উপকৃত হবে। প্রতিবন্ধীদের কি কি বাধা থাকতে পারে, কি কি সমস্যা হতে পারে। এর উপায় কি? সব এই বইতে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, শারীরিক অক্ষমতা কোনো বাধা হতে পারে না মানুষের জীবনে সেটাই ফুটিয়ে তুলেছি। তার এ সফলতার সঙ্গে কারা যুক্ত ছিলেন তিনি এ বিষয়টি বইয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সকলের পাশে থাকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। নিজের এক পা দিয়ে আঁকা বেশ কয়েকটি ছবির মাধ্যমে তার জীবনের সকল বাধা, প্রতিবন্ধকতা ও সাফল্য উল্লেখ করেছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। 
তিনি জানান, ‘এই বইটি শুধু প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীদের জন্য নয়; সাধারণ ছেলে মেয়েদের জন্যও। যারা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে; তাদের জন্য এই বইটি অনুপ্রেরণা জোগাবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে সমাজও পরিবর্তন হবে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে লেখা শুরু করি। এরপরের মাস সেপ্টেম্বরে বইটি অর্থাৎ এক মাসে লেখা শেষ হয়। তবে এতদিন অর্থের অভাবে বইটি পাবলিশ করতে পারিনি। প্রায় এক হাজার কপি প্রকাশিত হয়েছে।’ 
তিনি জানান, আমার সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করি। তাই আরও লেখালেখি করার ইচ্ছা রয়েছে বলে জানান তিনি। লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস ক্যাডার অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তামান্না। আর সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই আগামী দিনগুলোর জন্য তিনি এখন থেকেই প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
তামান্নার প্রকাশিত বইয়ের বিষয়ে যবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মেধাবী শিক্ষার্থী তামান্না শিক্ষার্থীদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমি জানতে পেরেছি তামান্নার লিখিত প্রথম বই ‘ইচ্ছার আলো’ প্রকাশিত হয়েছে। সকল প্রতিকূলতা ও বাধাকে অতিক্রম করে অদম্য তামান্না কিভাবে নিজেকে অনন্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন সেগুলো খুব দারুণভাবে উপস্থাপন করেছে। চরম ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো বাধাই কারও প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারে না সেটাই তিনি প্রমাণ করেছেন। তামান্নার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি এবং তিনি অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। উপাচার্য হিসেবে আমি ইতোপূর্বে তার পাশে ছিলাম এবং আগামীতেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে। উল্লেখ্য, বইটির প্রকাশনা করেছে তামান্না ফাউন্ডেশন, প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ এবং বইটি এখন ২০% ছাড়ে মাত্র ৩০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। তামান্নার বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার দাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (ননএমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছয় বছর বয়সে তামান্নাকে পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করে তার পরিবার। সেখান থেকে তার ইচ্ছা শক্তির উপর ভর করে বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করে। এরপর ছবি আঁকা শুরু করে তামান্না। তার আঁকা অনেক ছবি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন তামান্না।

২০২১ বছরে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পরে গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাসহ দুটি স্বপ্নের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তামান্না। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অডিওকলে ফোন দিয়ে তামান্নাকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। একইসঙ্গে দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে যেকোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেন। বর্তমানে তামান্না যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

×