
ক্রীড়াবিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন সান্তনা রানী রায়
এক সময় ঝিয়ের কাজ, লাঙ্গল চালিয়ে জমিতে চাষ করেছিলেন। এরপরেও মনোবল ধরে রেখে সফল ক্রীড়াবিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন সান্তনা রানী রায়। সান্তনার এখন বড় পরিচয় তিনি আন্তর্জাতিক তায়কোয়নদোর একজন সফল খেলোয়াড়। এই ডিসিপ্লিনের বিশ্বকাপেও খেলেছেন দুইবার। এর মধ্যে একবার ব্রোঞ্জ পদকও জিতেছেন। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে ১৯টি পদক তিনি পেয়েছেন। মার্শাল আর্ট তার স্বপ্নে-ভালোবাসা। মার্শাল আর্ট নিয়েই গৌরবময় জীবনে পদার্পণ করেছেন কৃষক পরিবারের এই কন্যা।
এই নারী ক্রীড়াবিদের জীবনের গল্পটা আলাদা। জীবন-সংগ্রাম কি সেটা হাড়েহাড়ে টের পেয়েই বড় হয়েছেন। সান্তনা রানী রায় উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের হরিদাস গ্রামের কৃষক সুবাস চন্দ্র রায় ও মা যমুনা রানীর এই মেয়ে। একের পর এক দেশে-বিদেশের মাটিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছেন সান্তনা রানী রায়।
এ পর্যন্ত তার সাফল্যের ঝুড়িতে ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বিপরীতে ১৩টি স্বর্ণ, চারটি রৌপ্য এবং দুটি ব্রোঞ্জ পদক রয়েছে। সর্বশেষ যে পদকটি সান্তনার গলায় এসেছে তা হলো কাজাখস্তান তায়কোয়নদো আইটিএফ অ্যাসোসিয়েশন ২২তম আইটিএফ তায়কোয়নদো ওয়াল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ (১৯-২৬ আগস্ট) ২০২৩। যা ২৫ আগস্ট দুপুরে ডিপিআর কোরিয়ার রি চোল ওক এবং বাংলাদেশের সান্তনা রানী রায়ের মধ্যে লড়াই ছিল। ৩৫-৪৪ বছরের ৭৭ কেজি ওজন ক্যাটাগরিতে (এক থেকে চার দ্যান ব্লাক বেল্টধারীদের মধ্যে) এ প্রতিযোগিতায় ডিপিআর কোরিয়ার রি চোল ওক প্রথম স্থান /স্বর্ণ পদক এবং বাংলাদেশের সান্তনা রানী রায় দ্বিতীয় স্থান/ রৌপ্য পদক লাভ করেন।
২২তম আইটিএফ তায়কোয়নদো ওয়াল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় পুরস্কার গলায় ঝুলিয়ে সান্তনা রানী রায় দেশে ফিরেছেন। এর আগে ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার পিশংইয়ংয়ে অনুষ্ঠিত ২০তম ওয়ার্ল্ড তায়কোয়নদো চ্যাম্পিয়নশিপে নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে তৃতীয় স্থান/ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। উল্লেখ, উপরোক্ত দুটি ওয়ার্ল্ড তায়কোয়নদো চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করলেও মার্শাল আর্ট কন্যা সান্তনা রানী রায় বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেন।
লালমনিরহাটের মার্শাল আর্ট কন্যা ২০১৪ সালে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান তায়কোয়নদো চ্যাম্পিয়নশিপে নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান/স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০১৮ সালে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাউথ এশিয়ান তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান/রৌপ্য পদক লাভ করেন। এরপর ২০১৯ সালে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ওপেন সাউথ এশিয়ান আইটিএফ তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান/ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।
এরপর ২০২৩ সালের চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান আইটিএফ তায়কোয়নদো প্রতিযোগিতায় নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান/স্বর্ণ পদক লাভ করেন। এর পাশাপাশি লালমনিরহাট তায়কোয়নদো অ্যাসোসিয়েশনের (এলটিএ) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক হিসেবে লালমনিরহাটের মার্শাল আর্ট কন্যা সান্তনা রানী রায় সিআরআই ইয়াং বাংলার জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ অর্জন করেন। সে সময় সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিনের নিকট থেকেও পুরস্কার পেয়েছিলেন সান্তনা রানী রায়।
লালমনিরহাটের আদিতমারীর সারপুকুর ইউনিয়নের হরিদাস গ্রামের প্রান্তিক ও অসচ্ছল পরিবার থেকে অতিকষ্টে সাফল্যের শিখড়ে উঠে আসা মার্শাল আর্ট কন্যা সান্তনা রানী রায় লালমনিরহাট জেলার সংগ্রামী নারী ও শিশুদের জন্য অনুকরণীয় আইকন হিসেবে উল্লেখ করেন লালমনিরহাটের বিশিষ্ট নারী অধিকার সংগঠক ফেরদৌসী বেগম বিউটি ও প্রতিবাদী নারী প্রভাষক এস তাবাসসুম রায়হান মুসতাযীর তামান্না। কৃষক পরিবারের মেয়ে সান্তনা রানী রায় তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে এলএলবি শেষ করছেন। শৈশবে গ্রামের বখাটেদের উত্ত্যক্তের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই হাতেখড়ি মার্শাল আর্টের। আর সেই মার্শাল আর্টই সান্তনার পথচলার সঙ্গী এখন।
এ জন্য লালমনিরহাটের আদিতমারীতে গড়ে তুলেন তায়কোয়নদো অ্যাসোসিয়েশনের (এলটিএ)। যা প্রতিষ্ঠাতা সান্তনা নিজেই। এখানে সে স্কুল কলেজের মেয়েদের মার্শাল আর্ট এর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। সান্তনার বাবা সুবাস চন্দ্র রায় বলেন, ‘মেয়েটা শৈশব থেকেই মার্শাল আর্ট নিয়েই পাগল। সারাক্ষণ শুধু মার্শাল আর্টের সঙ্গেই সখ্য তার। সান্তনার মা যমুনা রানী জানান, আমার মেয়েটি বড়ই পরিশ্রমী। তার মনোবল আজ তাকে সফলতার মুখ দেখিয়ে যাচ্ছে। সবাই আমার মেয়ের জন্য প্রার্থনা করবেন সে যেন সুনামের সঙ্গে তার সফলতা বজায় রাখতে পারে।