ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন

সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন

গৃহশ্রমিকদের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে

সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী গৃহশ্রমিকদের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুসারে দেশে গৃহশ্রমে কাজ করছে এমন শিশুর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। বড় ধরনের গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ মামলায়  দু-পক্ষের মধ্যে নানা কারণে আপোস হয়ে যায় বলে পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে সাজা হয়েছে এমন মামলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হলেও আদুরী (১১) নির্যাতন মামলায় ২০১৭ সালে গৃহকর্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ হয়।

গৃহশ্রমিকের সুরক্ষায় প্রণীত গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩, ২৪ ও ২৫-এ সব শ্রমিকের সমান কাজের জন্য সমান মজুরি নীতির ভিত্তিতে ন্যায়সংগত মজুরির বিনিময়ে স্বাধীনভাবে কর্ম নির্বাচন, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, সাময়িক ছুটিসহ বিশ্রাম ও বিনোদন, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাস, পরিবারসহ মানবিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।
‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’ এই নীতি সম্পর্কে অনেকেই অবগত নয়। গৃহকর্মীর পারিশ্রমিক নির্ধারণের বিষয়ে উক্ত আইনের ধারায় যথাক্রমে ক) মজুরি নির্ধারণ খ) খ-কালীন মজুরি ও গ) মজুরি পরিশোধ করার বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি অনুযায়ী ‘গৃহকর্ম’ বলতে রান্না-বান্নাসহ সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক কাজে সহায়তা, বাজার করা, গৃহ বা গৃহের আঙ্গিনা বা চত্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং গৃহের অন্যান্য কাজ যা সাধারণত: গৃহস্থালি কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়াও পোশাক-পরিচ্ছদ ধোঁয়া, গৃহে বসবাসরত শিশু, অসুস্থ, প্রবীণ কিংবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যতœ ইত্যাদি কাজও গৃহকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে। আর ‘গৃহকর্মী’ বলতে এমন কোনো ব্যক্তিকে বোঝাবে যিনি নিয়োগকারীর গৃহে মৌখিক বা লিখিতভাবে খ-কালীন অথবা পূর্ণকালীন নিয়োগের ভিত্তিতে গৃহকর্ম সম্পাদন করেন। এ ক্ষেত্রে মেস বা ডরমিটরিও ‘গৃহ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। ‘নিয়োগকারী’ অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যিনি স্বীয় গৃহ, মেস ও ডরমিটরিতে গৃহকর্মের জন্য কর্মী নিয়োগ করেন।
গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালায় বলা আছে, ‘আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গৃহকর্মীর মজুরি নির্ধারণ হবে। পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে তাঁর পরিবারসহ সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপনের উপযোগী হয়, নিয়োগকারীকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কমপক্ষে ১৪ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে। তবে ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ অ্যান্ড ডিনেটের সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের বেশিরভাগ গৃহকর্মী প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার ৩১১ টাকা আয় করেন যা গৃহকর্মীদের  মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অপর্যাপ্ত। এছাড়া ২৩ শতাংশ গৃহকর্মীদের গত বছরে হাসপাতালে চিকিৎসা বাবদ ব্যায় হয়েছে ২৫ হাজার ৯৯৯ টাকা।
গৃহকর্মীদের কোনো নিবন্ধন নেই যেখানে জীবন বৃত্তান্ত পাওয়া যাবে তাদের। শিশু গৃহকর্মীদের নিবন্ধন ও নিয়মিত পরিদর্শন এর নির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। যার ফলে শিশু গৃহকর্মী নির্যাতন ঘটনা থেকে পরিত্রান দূরহ বিষয়। শিশুশ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের আওতায় নিয়ে আনতে হবে। যদি ১২ বছরের শিশুকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে যে হালকা কাজ করবে বলা আছে, নীতিমালায় বলা আছে।

নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে যে কোনো ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার হবে। গৃহকর্মীদের শ্রম আইন ২০০৬ এ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইএলও কনভেনশন ১৮৯ এর অনুস্বাক্ষর এবং গৃহকর্মীদের প্রতি শোভন ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মানবিকতার উন্মেষ ঘটিয়ে গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় নিয়োগকারী ব্যক্তিকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই গৃহকর্মীরা প্রাপ্ত হবে তাদের ন্যায্য অধিকার।
লেখক : আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

×