
গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন কোনো কোনো গৃহকর্ত্রী বা গৃহস্বামীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে
গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন কোনো কোনো গৃহকর্ত্রী বা গৃহস্বামীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারাও যে মানুষ এ উপলব্ধিও হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। বিশেষত শিশু গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন যেভাবে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া তো নারী গৃহপরিচারিকাদের একাংশের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না।
সবশেষ গত শুক্রবার কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডে এক বাসায় ৮ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা ঘটে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারাদেশে ২৬ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের ১৪ জন নিহত হয়। আবার চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ জন নির্যাতনের শিকার হন, যেখানে নিহত হয় ১০ জন।
গৃহশ্রমিকরা অর্থনৈতিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সব দিক দিয়েই দুর্বল অবস্থানে থাকে। ফলে তাদের নির্যাতনে জড়িতদের সাজা হয় না বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সমাজে বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি বহমান। এ কারণে সাধারণ মানুষ বা দুর্বল মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। যদিও-বা কোনো কোনো বিষয়ে মামলা হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থের দাপট, পেশির দাপট এবং রাজনৈতিক দাপটের কাছে পরাস্ত হতে হয় দুর্বলদের। ফলে শুরুতে অথবা মাঝপথে আইনবহির্ভূত সমঝোতা লক্ষ্য করা যায়। সাক্ষী সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় এই দুর্বল মানুষের পক্ষে দ্বিধাহীনচিত্তে সাক্ষ্য দিতে কেউ এগিয়ে আসে না।
শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ, এদের শতকরা ৮০ ভাগই নারী। দেশে ১১টি দৈনিক সংবাদপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে বিলসের গবেষণায় দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ৩৩ জন গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়াও গত ১০ বছরে (২০১১ থেকে ২০২১) ৫৮৫ জন গৃহকর্মী হতাহত হয়েছেন। সুনীতি প্রকল্প পরিচালিত বিলসের ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ৮৪ শতাংশ গৃহশ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। গৃহকর্মীদের ৬৭ ভাগ মানসিক, ৬১ ভাগ মৌখিক এবং ২১ ভাগ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ না হওয়ার বড় কারণ শাস্তির নজির না থাকা। গৃহকর্মী নির্যাতনের বেশিরভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকা ও প্রভাবশালীদের চাপের মুখে আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হয়ে থাকেন। মূলত মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীদের বারবার উৎসাহিত করছে। দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে কখনো গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধ হবে না।
সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারা এলাকায় অঞ্জনা নামে এক গৃহকর্মীকে সাত বছর ধরে একটি বাসায় আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনা সারা দেশে সমালোচনা তৈরি হয়।
গৃহ শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর কাছে সারাদেশে কি পরিমাণ গৃহকর্মী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। গৃহ শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ২০ লাখের বেশি গৃহকর্মী রয়েছে, যাদের ৮০ শতাংশই নারী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৪শ’ গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার বিভিন্ন থানায় প্রায় দুশ’র মতো নির্যাতন ও অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আসকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ জন নারী গৃহকর্মী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন নিহত হয়েছেন। দুজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের মারা গেছেন ৪ জন, ৬ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ও ৬ জনের নির্যাতনের ধরন জানা যায়নি। দেখা গেছে, ১৮ গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫টি। তিনটির ঘটনায় কোনো আইনি ব্যবস্থার তথ্য পায়নি সংস্থাটি।
অন্যদিকে আসকের ২০২২ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই বছর মোট গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। যার মধ্যে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। ওই বছর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ১১ জন, ধর্ষণের শিকার ২ জন, আত্মহত্যা করে একজন, শারীরিক নির্যাতনে মৃত্যু একজন এবং ১১ জনের নির্যাতনের ধরন জানা যায়নি। এসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৪টি এবং ১২টির মামলা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) কয়েক বছর আগের এক জরিপে অংশ নেওয়া ২৮৭ জন গৃহ শ্রমিকের ৫০ ভাগ জানিয়েছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিলস তথ্য বলছে, সারাদেশে মোট গৃহকর্মীর ৯৫ ভাগেরও বেশি নারী। গৃহকর্তার কাছে ৫০ শতাংশ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হন। যাদের অর্ধেকই আবার শিশু। বিলসের আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে সারা দেশে ১ হাজার ৫৬০ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, আহত, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা ও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে লাশ হয়েছেন ৫৭৮ গৃহকর্মী।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক বলেন, গৃহশ্রমিক নির্যাতন বা হত্যা মামলার ঘটনায়, দুই-একটি মামলায় রায় পাওয়া গেছে বা বিচার পাওয়া গেছে। বাদ বাকি ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো এমন ঘটনা আমার জানা নেই। হয়তো ১০ বছরে ১০টা এমন ঘটনা আছে। ৫০০ কেসের মধ্যে যদি ১০টার বিচার হয়ে থাকে, তাহলে বাকিগুলোর তো হয়নি। তাই সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব নাজমা ইয়াসমীন বলেন, গৃহকর্মীদের শ্রম আইন, ২০০৬-এ অন্তর্ভুক্তি করতে হবে, আইএলও কনভেনশন ১৮৯-এর অনুস্বাক্ষর এবং গৃহকর্মীদের প্রতি শোভন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ মামলায় আপস হয়ে যায়। থানা থেকে চার্জশিট দিতে দেরি করে। যারা মামলা করে তাদের কিংবা তাদের অভিভাবকদের আসামিরা টাকা দিয়ে আপোস করতে রাজি করে ফেলে। ফলে মামলাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণে সাজা হয়েছে এমন মামলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সবশেষে বলতে হয়, আগে গৃহকর্মীরা কোনো বাসায় কাজ করতে গেলে গৃহকর্ত্রীর মত সম্মান পেত। তারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতো বলেই সংসারের একজন সদস্যের মরযাদা পেত। কিন্তু সম্প্রতি গৃহকর্মী ও গৃহকর্ত্রীর মধ্যে এই আস্থার জায়গায় ফাটল তৈরি হয়েছে। একজন চাকরিজীবী গৃহকর্মীকে মাসে ১২/১৫ হাজার টাকা বেতন দেবার পরও সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতে হয় শিশুকে নিয়ে। সেই দায়িত্ববোধের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে গৃহকর্মীর মাঝে। অনেকে ছোট শিশুকে গৃহকর্মীর কাছে রেখে গিয়ে বাসায় রুমে সিসি ক্যামেরা লাগাচ্ছে। অফিস থেকে মনিটরিং করার জন্য। এই যে আস্থার বা ভরসার ঘাটতি সেটা গৃহকর্ত্রীর দায় নেই। গৃহকর্মীরা বাসায় গৃহকর্ত্রীর অবর্তমানে চুরি থেকে শুরু করে বাচ্চাকে মারধর করে, ঠিকমতো যতœ করে না। দায়িত্বের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই থেকেই আস্থাহীনতার শুরু।