ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এফবিআই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার সুনন্দা রায়

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ০১:৫৩, ২০ জানুয়ারি ২০২৩

এফবিআই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার সুনন্দা রায়

সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একমাত্র নারী

সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একমাত্র নারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (এফবিআই) প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার নাম সুনন্দা রায়। অপরাধ তদন্তে বিশে^র অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এফবিআই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি দেশের সুনাম বয়ে এনেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই বাংলাদেশের সুনন্দা রায়ের কর্ম মেধা ও বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণ করে তাকে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করে।

তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই একাডেমি কোয়ান্টিকোতে এক বছর প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে এসপি পদমর্যাদার সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল (এআইজি) পদে ক্রাইম এ্যানালাইসিস বিভাগে কর্মরত। চলতি বছর পুলিশ সপ্তাহে তিনি পুলিশের সম্মানজনক পদক বিপিএম পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে পদক পরিয়ে দেন।

সুনন্দা রায়ের স্বামী সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বগুড়ার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। তিনিও এ বছর একই অনুষ্ঠানে পিপিএম পদক পেয়েছেন। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা দম্পতির এমনভাবে জুটিবদ্ধ পদক পাওয়ার ঘটনা দেশে এই প্রথম। সুদীপ চক্রবর্ত্তী এর আগে বিপিএম পদকও পেয়েছেন। 
সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী ও সুনন্দা রায় জুটি জীবনকে বর্ণাঢ্য করে তুলেছেন তাদের মেধাদীপ্ত সৃষ্টিশীল কর্ম দিয়ে। দুজনই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৪তম ব্যাচ। দুজন একই তারিখে পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। সুদীপ চক্রবর্ত্তীর বাড়ি ময়মনসিংহ। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে কৃষিতে অনার্সের পর মাস্টার্স করেছেন। সুনন্দা রায়ের বাড়ি সিলেট। তিনি সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে অনার্সের পর মাস্টার্স করেছেন।

পুলিশ বিভাগে যোগদানের পর তাদের ট্রেনিং নিতে হয় রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে। সেখানে সুদীপ ও সুনন্দা এই দুই মেধাবীর প্রণয়ের অভিষেক হয়ে যায়। দুবছর পর ২০০৭ সালের ১১ জুলাই মিষ্টিমধুর প্রণয় সাত পাকে বেঁধে পরিণয়ে রূপ নেয়। পুলিশ কর্মকর্তা জুটির এমন কিছু তারিখ আছে যা দুজনের একই সময়ে ঘটেছে। যেমন ২০১২ সালে দুজনই একসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) হিসেবে যোগদান করেন। 
সুদীপ ও সুনন্দা দুজনই পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির পথে হাঁটছেন। তৈরি করেছেন একান্ত আপন ভুবন। সাহিত্যের প্রতি সুদীপের আকর্ষণ ছেলেবেলা থেকে। তিনি কবিতাপ্রেমী। কবিতা লিখেন। আবৃত্তি করেন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। পারিবারিক পরিম-লের আবহে এই ধারা চলে এসেছে। সুনন্দা একই ধারার। সুকণ্ঠের অধিকারী সুনন্দা আবৃত্তিকার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ পুলিশের বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি সঞ্চালনার দায়িত্ব পান। পুলিশের চাকরিতে অবসর খুব কম। তারপরও সময় পেলে দুজনই রবীন্দ্র সংগীত ও পুরনো দিনের গান শোনেন। তাঁদের দুই কন্যা। একজন নবম শ্রেণি আরেকজন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। 
কর্মজীবনে দুজনই জাতিসংঘ পিস কিপিং মিশনে গেছেন। এ ক্ষেত্রে সুনন্দা রায়ের পাল্লা ভারি। তিনি ইংল্যান্ড, হাওয়াই, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গেছেন। এফবিআই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর সুদীপ চক্রবর্ত্তী গেছেন ইতালিতে। বাঙালী নারী সুনন্দা রায়ের কর্মজীবনে মেধাভিত্তিক ছাপ রাখছেন। যেমন তিনি ডিএমপির ইনটেলিজেন্স অ্যানালাইসিস ডিভিশনের প্রধান ছিলেন। ডিএমপিতে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে কাজ করেছেন। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) ও ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে (সিআইডি) দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নে তিনি প্রমাণ করেছেন মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকেন। অপরাধ বিশ্লেষণ করে অপরাধ দমনের কৌশলে তিনি পুলিশ বিভাগকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। দেশ এভাবেই নারীর ক্ষমতায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। 
এই জুটির সঙ্গে কথা বললে মনে হবে বাঙালীর সংস্কৃতির আবহে তারা বেড়ে উঠেছেন। পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিপরীত ধারণার ঊর্ধ্বে তারা। সাধারণ মানুষের সমস্যায় তারা গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেন। এই জুটির হৃদয় বন্ধনের গল্পটি শুনলে মনে হবে প্রকৃতিই তাদের এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে। যেমন সুদীপ চক্রবর্ত্তীর বাড়ি ময়মনসিংহ। যা ভাটির অঞ্চল। এই ভাটির স্রোত প্রকৃতি টেনে নিয়েছে সিলেটের ভূমিতে। ভাটির সেই টানে ও ধারায় সুদীপের দীপ জ¦লেছে সুনন্দার হৃদয়ে। গড়ে উঠেছে অপার মধুময়তা।
তাদের জীবন সংসারের ধারাও বেশ ব্যতিক্রম। একজন ঢাকা ও একজন বগুড়ায়। সড়ক পথে দূরত্ব প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার। তার ওপর পুলিশের পেশা চ্যালেঞ্জিং। সাপ্তাহিক ছুটি আছে কাগজে কলমে। দায়িত্ব আছে চব্বিশ ঘণ্টা। টুয়েন্টিফোর বাই সেভেন। তারপরও তো মানুষের ক্লান্তি আসে। তারা হাসিমুখে রবীন্দ্রনাথের সুর হৃদয়ে লালন করেন ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করও প্রভু পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।’ সুদীপ চক্রবর্ত্তী বলেন দূরে থাকার  সড়ক পথ আকাশ পথ নৌপথের সকল দূরত্ব এখন বিজ্ঞান এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। নেট আর স্মার্ট ফোন দূরকে কাছে টেনে এনেছে। হৃদয়ের আবেগকে পূরণ করে দিয়েছে দায়িত্ব পালনে। সুদীপ চক্রবর্ত্তী তাদের জীবনের একটি ঘটনা তুলে ধরেন এভাব- ঢাকায় থাকেন। তখন তাদের ছোট মেয়ের বয়স দু’বছর, বড় মেয়ের ন’বছর। তাদের মা সুনন্দা এফবিআই প্রশিক্ষণে। সুদীপকে একরাতে বাড়িতে ফিরতে হয় রাত আড়াইটায়। পরদিন সকাল ৮টায় ফের যেতে হবে। সুদীপ সকালে উঠে কাজে যাওয়ার জন্য ইউনিফর্ম পরে বের হতে ছোট মেয়ে সুধায় ‘বাবা আজ রাতে তুমি আমাদের বাসায় এসো।’ আমরা বাইরে থেকে পুলিশকে যে ভাবেই দেখি যত সমালোচনাই করি পুলিশের জীবনের যে কথাগুলো বেহালার সুরের মতো বাজে তা আমরা শুনি না। এই জুটির হৃদয় একে অপরের জন্য কত বড় তার প্রমাণ দেয় রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতরের একটি সুর ‘শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া। চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে নিয়ো          না সরায়ে।’

×