ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অদম্য তরুণ শফিকুল হক লাখো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৫০, ৩১ মার্চ ২০২৩; আপডেট: ১৬:০৭, ৩১ মার্চ ২০২৩

অদম্য তরুণ শফিকুল হক লাখো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা

অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষের দ্বারা অসম্ভব কিছু থাকে না

অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষের দ্বারা অসম্ভব কিছু থাকে না। পৃথিবীতে এমন নজির অনেক আছে। তেমনি একজন শফিকুল ইসলাম।
দিনমজুরের ঘর থেকে বেড়ে ওঠা শফিকুল তাঁর মেধা ও অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজ তিনি বিসিএস ক্যাডার। জন্ম কুড়িগ্রাম জেলা সদরের পলাশবাড়ির চকিদার পাড়ায়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শফিকুল পরিবারের চতুর্থ সন্তান। পড়াশোনার খরচ আর পরিবারের দায় মেটাতে এক সময়ের ট্রাকের হেলপার ছেলেটি  স্কুল জীবন পার করেছিল এক জোড়া প্যান্ট-শার্ট দিয়ে।

স্কুলে একবার নিয়ম করা হলো পায়ে জুতো ছাড়া কেউ স্কুলে আসতে পারবে না। অনন্যোপায় ছেলেটি স্কুলে গেল খালি পায়েই। বসল সবার পেছনে যাতে শিক্ষকের নজরে না পড়ে। শিক্ষক বললেন আজও যারা জুতো ছাড়া এসেছে তারা যেন ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। পরদিন কেউ আর মিস করবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে ক’জন আনেনি তারা রক্ষা পায়। কিন্তু পেছনে বসা ছেলেটি অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। আজি হয়ত তার স্কুলের শেষদিন। তার কান্না দেখে সেদিন ক্লাসের সবাই মিলে এক জোড়া জুতা কেনার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল।
দারিদ্র্যতা আর পারিপার্শ্বিকতায় থেমে থাকা লাখো শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা জাগিয়ে,  আবদুল খালেকের অদম্যপ্রাণ সেই ছেলেটিই ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় জেলার ৩৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করে দেওয়া এই যুবক, মো. শফিকুল ইসলাম। 
শফিকুলের সংগ্রামী জীবনের গল্প কুড়িগ্রামের মানুষের মুখে মুখে। ২০০৫ সালে যখন মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হয়েছে, তখন সে হেলপার হিসেবে ট্রাকের সঙ্গে মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যস্ত ছিল। তাই রেজাল্ট জানতে পারেনি। পরদিন বাড়ি ফিরে দেখে দারুণ এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য! পুরো কুড়িগ্রাম জেলায় মানবিক বিভাগ থেকে সেবার একমাত্র শফিকুলই পেয়েছিলেন জিপিএ ফাইভ! পত্রিকায় সেই সংবাদ দেখে সংগীত শিল্পী কনকচাঁপা এই অদম্য মেধাবী ছেলেটির চমকপ্রদ ফলাফলের সংবাদ শুনে তাকে সাত হাজার টাকা শুভেচ্ছা হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।

বিভিন্ন বৃত্তি পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ২০০৭-০৮ সেশনে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। অনেকে মনে করতেন কুড়িগ্রাম জেলার দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে তাকে বাবা আবদুল খালেকের মতো জলিল বিড়ির ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু শ্রমিক আবদুল খালেক চাননি ছেলেটিও তার এই পেশায় আসুক। দরিদ্র বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তার পড়াশোনা করে বড় হোক। ‘গরিবের ঘোড়ারোগ’ দেখে আশপাশের মানুষের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যও তাকে সইতে হয়।

শফিকুলের বাবা আবদুল খালেক বলেন, ‘আমার ছেলে কষ্টের প্রতিদান পেয়েছে। অনেকের সাহায্য নিয়ে, নিজে অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। ওর এই সাফল্যে আমরা খুব খুশি।’ বাবা আবদুল খালেক আরও বলেন, ‘টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়াতে পারিনি। সংসারে আমার আরও চার ছেলে থাকলেও ওদের কারও সামর্থ্য ছিল না আর্থিক সহায়তা করার। পরে পাশের গ্রামের লাভলু নামের এক শিক্ষার্থী টাকা না নিয়েই প্রাইভেট পড়ায় শফিকুলকে। ওর স্কুলের শিক্ষকরাও টাকা-পয়সা দিয়ে যথেষ্ট সহায়তা করেছে।

এ কারণেই ও পড়ালেখা করতে  পেরেছে।’ শফিকুল জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পর মহানুভব শিক্ষক মোজাফফর স্যার নিজে শফিকুলের বেতন দেন। পরবর্তীতে স্কুলে বিনা বেতনে পড়াশোনা করার ব্যবস্থাও করে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলে উঠে। সেখানে শুরু হয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আরেক নতুন সংগ্রাম। যদিও তার কাছে তখন আর কিছুই অভাবনীয় বা অসহনীয় নয়। নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে ঢাকা শহরে লিফলেট বিলি করেছেন, কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করেছেন।

প্রতিদিন দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাই যার কাছে ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। সে সংগ্রামে পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আরও অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে শফিকুল যখন বিসিএসের ভাইভা দেবে তখন ভাইভার জন্য ফরমাল কোনো পোশাক ছিল না। শার্ট, প্যান্ট ও এক জোড়া জুতা কিনার জন্য পরিচিত একজনের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। সাহায্য তো দূরে থাক, উল্টো তাকে চরম অপমান সইতে হয়েছিল। 
শফিকুল বলেন, ‘অভাবের জীবন আমি পদে পদে উপলব্ধি করেছি। আমার শিক্ষক আর কিছু মহানুভব মানুষের সহযোগিতায় আজ আমি এ পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়েছি। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’ ভবিষ্যতের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, বাবা-মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালুর স্বপ্ন আছে আমার। তবে সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে আমি অবশ্যই আমার মতো অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে চাই। টাকা-পয়সার অভাবে কারও পড়ালেখা যেন থমকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চাই আমি।’ এছাড়া, নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার ও বয়স্কদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করার ইচ্ছার কথাও জানান শফিকুল। 
তিনি বলেন, মে মাসের দুই তারিখে চাকরিতে জয়েন করার আগে বাড়ি যাই। রাতে খাবার খেতে বসে দেখি ঘরের চালের ফুটো দিয়ে ভাতের থালায় জোছনার আলো ফিনকি দিয়ে নামে। চালের ফুটো দিয়ে আসা এ আলোকে এখন তিনি দেখেন অনুপ্রেরণা হিসেবে।

ডেস্ক রিপোর্ট

×