
ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার রাস্তায় ক্যামেরা যখন ঘোরে, তখন শিশুদের মধ্যে কোনো কৌতূহল নেই। মৃত্যুর মুখোমুখি জীবন তাদের বিস্ময়ের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। অনাহারে, ক্ষুধায় তারা ক্লান্ত, দুর্বল। খাদ্যসামগ্রীর জন্য তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে — কখনও কিছু মেলে, কখনও কিছুই না।
গত ১৯ মাস ধরে চলমান যুদ্ধে, এবং এখন ফের শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে, বিবিসির স্থানীয় এক ক্যামেরাম্যান—যার নাম তার নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ করা হচ্ছে না—এই সব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আসছেন। হাসপাতালের আঙিনায় আহতদের আর্তনাদ, শিশুদের মৃত্যু, এবং তাদের শরীর বা দেহাংশ সাদা কাফনে জড়ানোর দৃশ্যগুলো তাকে ভেঙে দিয়েছে।
সেই ক্যামেরাম্যান এবার খুঁজতে বের হয়েছেন পাঁচ মাস বয়সী শিশু সিওয়ার আশুর-কে, যার শুকিয়ে যাওয়া শরীর ও নিঃশেষ কণ্ঠস্বর তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে এর আগে চিত্র ধারণের সময় তিনি সিওয়ারকে দেখেছিলেন, তখন তার ওজন ছিল মাত্র ২ কেজির সামান্য বেশি — যা বয়স অনুযায়ী অর্ধেকেরও কম।
সিওয়ারের রয়েছে একটি দুধ-সংক্রান্ত অ্যালার্জি, যার কারণে তাকে বিশেষ ফর্মুলা মিল্ক খাওয়াতে হয়। কিন্তু ইসরায়েলি অবরোধের কারণে সেই দুধ এখন প্রায় অপ্রাপ্য।
শিশুটির মা নাজওয়া, বয়স মাত্র ২৩, বলেন, “হাসপাতালে থাকার সময় ও একটু সুস্থ হয়েছিল বলে ডাক্তাররা ছাড়পত্র দেয়। একটা মাত্র দুধের কৌটা দিয়েছিল। এখন সেটা শেষ হতে চলেছে। আমি দেখি ও আগের মতোই শুকনা, তেমন উন্নতি হয়নি।”
তিন সদস্যের পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে একটি ছোট্ট টিন-ছাওয়া এক কক্ষে, যার দরজা একটা পর্দা। ঘরে আছে মাত্র তিনটি বিছানার তোশক, একটা ড্রয়ার, আর একটি আয়না যেটা সূর্যকিরণ প্রতিফলিত করে সিওয়ারের মুখে এসে পড়ে।
নাজওয়া বলেন, “অবস্থাটা খুবই খারাপ। ওর শরীরের ওপর পোকামাকড় উড়ে বেড়ায়। আমি ওকে স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখি যেন কিছু না লাগে।”
সিওয়ার জন্মেছে গত নভেম্বরের যুদ্ধের মধ্যেই। গোলা, গুলি, বোমা—এসব শব্দ তার শৈশবের সঙ্গী। নাজওয়া বলেন, “ট্যাংক, যুদ্ধবিমান আর রকেটের শব্দ শুনলেই ও কেঁদে উঠে। ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে ওঠে।”
তিনি নিজেও অপুষ্টিতে ভুগছিলেন যখন সিওয়ারের জন্ম দেন। এখনো মা ও মেয়ের জন্য পর্যাপ্ত খাবার, পানি, এমনকি ডায়াপার বা দুধ জোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নাজওয়া বলেন, “এই দুধ, এই ডায়াপার — এগুলোর দাম অনেক বেশি, আর সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।”
ইসরায়েলি সামরিক কর্তৃপক্ষ কোগাট ২২ মে দাবি করেছিল, গাজায় কোনো খাদ্যসংকট নেই, এবং "বেশ কিছু পরিমাণ শিশুখাদ্য ও আটা" ঢুকেছে।
তবে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ কোগাটের দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইসরায়েল যে পরিমাণ সাহায্য ঢুকতে দিচ্ছে, তা “এক চামচের সমান।” তিনি গাজাবাসীদের এই পর্বকে “সবচেয়ে নিষ্ঠুর” সময় বলে অভিহিত করেছেন।
বর্তমানে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৮০% এলাকা হয় ইসরায়েলি সামরিক জোন ঘোষণা করা হয়েছে, নয়তো বাসিন্দাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে।
নাজওয়া বলেন, “আমরা ভবিষ্যৎ বা অতীত নিয়ে ভাবি না। শুধু বর্তমানটা কিভাবে টিকে থাকব, সেটাই দেখার।”
সিওয়ার, তার মা নাজওয়া, এবং তার দাদি রীম—এই তিনজনের বেঁচে থাকার লড়াই এখন গাজার ২১ লাখ মানুষের প্রতিচ্ছবি।
এসএফ