ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ইজরায়েল: কোথায় যাচ্ছে ভারত?

মুহাম্মদ ওমর ফারুক

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ইজরায়েল: কোথায় যাচ্ছে ভারত?

ছবি: সংগৃহীত

ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং ক্রমেই এটি একটি সাংগঠনিক সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। ধর্মীয় নিপীড়নের পাশাপাশি মুসলমানরা আর্থিক, সামাজিক এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন — এমন অভিযোগ বহুদিনের। মসজিদে নামাজ শেষে মুসল্লিদের উপর পুলিশের নৃশংস লাঠিপেটা, মসজিদের সামনে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে উগ্রপন্থীদের অস্ত্র মহড়া, সামাজিক বয়কটসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলিমদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছুদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রী মুসকান খান হিজাব পরে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে গেলে হিন্দুত্ববাদী ছাত্র সংগঠন আরএসএস-ঘনিষ্ঠ উগ্রপন্থী একটি গোষ্ঠী তার পথরোধ করে। তারা 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দিতে থাকে এবং প্রকাশ্যে তার প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হেনস্তা করে। মুসকান একা, সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গিয়ে উত্তরে 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দেন এবং মাথা উঁচু করে প্রতিরোধ করেন — যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে।

মুসকান কাণ্ডের পর কর্ণাটকসহ ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে হিজাব নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে আদালত পর্যন্ত মামলা গড়ায় এবং এক ধরণের সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম হয় — ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের বিপরীতে রাজ্যের স্কুল-ড্রেস কোডের প্রশ্ন উঠেছিল। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় প্রকাশ্যে মুসলিম নারীদের হিজাব খুলে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও কর্ণাটক রাজ্যে এমন ঘটনায় নারী নিরাপত্তা ও ধর্মীয় অধিকারের বিষয়টি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও রিপোর্টে দেখা যায়, কিছু উগ্রপন্থী যুবক মুসলিম তরুণীদের হিজাব টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে, মুসলিম পোশাক পরার জন্য হেনস্তা করছে।

এর আগে একটি মন্দিরে পানি খাওয়ার অভিযোগে ১২-১৩ বছর বয়সী এক মুসলিম শিশুকে কয়েকজন ব্যক্তি নির্মমভাবে প্রহার করে। একই ধরনের আরও বহু ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে মুসলিমদের বিনা উসকানিতে ধরে জোরপূর্বক 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এসব ঘটনাকে অনেক মানবাধিকার সংগঠন "ধর্মীয় নিপীড়ন", "নারী অধিকার লঙ্ঘন", এবং "হেট ক্রাইম" (ঘৃণাজনিত অপরাধ) বলে আখ্যা দিয়েছে। 

২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর ভারত সেখানে ব্যাপক সেনা মোতায়েন ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। বর্তমানে কাশ্মির বিশ্বের অন্যতম সেনা নিয়ন্ত্রিত (মিলিটারাইজড) অঞ্চল। এই পরিস্থিতির তুলনা করা হচ্ছে ইজরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সঙ্গে, যেখানে ব্যাপক সামরিক দমননীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। পাহেলগামে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের দিয়ে সাধারণ কাশ্মীরিদের হত্যা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব ঘটনাকে "রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস" ও "রাষ্ট্রীয় দমননীতির অংশ" বলে উল্লেখ করছে।

আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) ও বিজেপির নেতৃত্বে ভারতে একটি "হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আসাম, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডসহ বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিম এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপর সহিংসতা ও বৈষম্যের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এসব কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ভারতকে একটি কার্যত একক ধর্মীয় (হিন্দু) রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। এই প্রক্রিয়ায় মুসলিমসহ অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব ক্রমাগত সংকুচিত করা হচ্ছে। ভারতের বর্তমান জাতীয়তাবাদী প্রবণতা অনেকাংশে ইজরায়েলের জায়নিস্ট জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

ইজরায়েলে 'জায়নিজম' যেমন ইহুদি জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ প্রচার করে। ঠিক তেমনি ভারতে বর্তমানে 'হিন্দুত্ব' মতবাদ হিন্দু জাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার হচ্ছে। জাতীয় পরিচয় নির্মাণে ধর্মের প্রাধান্য এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নীতি - এই দুই ক্ষেত্রেই ভারত ও ইজরায়েলের মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে।

ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়: ধর্মভিত্তিক জাতীয় পরিচয় গঠন, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, সামরিক দখল ও দমননীতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা এই উপাদানগুলো ইজরায়েলের রাষ্ট্রনীতির অনেক দিকের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে বলা যায়, ভারতের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো দক্ষিণ এশিয়ায় "ইজরায়েল মডেল" অনুসরণের দিকেই এগোচ্ছে — বিশেষ করে সংখ্যালঘু প্রশ্ন এবং অধিকৃত অঞ্চলের শাসননীতিতে।

এফএ

×