ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

ফিরে আসছে ঠাণ্ডা যুদ্ধের দিন...

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

ফিরে আসছে ঠাণ্ডা যুদ্ধের দিন...

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের উত্তেজনার পারদ চড়ছিল স্ক্রিপাল কা-ে। কূটনীতিক বহিষ্কার, কনসুলেট বন্ধ করে দেয়া থেকে বাতাসে ভাসছিল নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা। পরিস্থিতি বিচারে জাতিসংঘ মহাসচিবের আশঙ্কাÑ বুঝি ফিরে এলো ঠা-া যুদ্ধের সেই দিনগুলো। এই যখন অবস্থা, গত শুক্রবার রাতে দুই মিত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়ায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা আগুনে ঢেলেছে ঘি। ক্রেমলিন রবিবার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, নতুন করে হামলা হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা’ তৈরি হবে বলে রাশিয়া মনে করে। আক্রমণ ঠেকাতে জাতিসংঘে ভোট চেয়ে ব্যর্থ পুতিন মরিয়া হয়ে নেমেছিলেন মিত্রের সন্ধানে। এবং তিনি তা পেয়েওছেন। বলা যায় আড়াআড়িভাবে দু’ভাগে বিভক্ত এক পৃথিবী। ঠা-া যুদ্ধ ছাড়িয়ে অনেকেই শুনছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। অন্তরালে দুই শীর্ষ নেতৃত্বের ইমেজ পুনরুদ্ধারের খেলা। সঙ্কটে সভ্যতা। লিখেছেন- সাবেক রুশ গুপ্তচর স্ক্রিপাল (৬৬) গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন ব্রিটেনের সালিসবেরি শহরে। সম্প্রতি সেখানে একটি পার্কে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মেয়ে জুলিয়ার সঙ্গে। ব্রিটিশ প্রশাসন অভিযোগ করে, পুতিন সরকারই ‘মিলিটারি গ্রেড’ নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টা করেছিল সাবেক এই রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়েকে। গোটা ঘটনায় রাশিয়ার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছিল ব্রিটিশ সরকার। ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে এর পরই বহিষ্কার করে ব্রিটেন। পাল্টা ২৩ জন ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে রাশিয়াও। ব্রিটেনের সঙ্গে সুর মেলায় মিত্ররা। ব্রিটেনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় ২০টি দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। রাশিয়া কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সুযোগটি চিনতে ভুল করেননি মোটেও। দেরি না করেই আমেরিকায় নিযুক্ত ৬০ রুশ কূটনীতিককে করলেন বহিষ্কার। বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন সিয়াটলের রুশ দূতাবাসটিও। রাশিয়া বরাবর স্ক্রিপাল ও তার মেয়েকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ খারিজ করেছে। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়া তা মানতে নারাজ। অতঃপর আমেরিকার ইটের জবাব পাটকেলেই দিয়েছেন মস্কো তথা ভøাদিমির পুতিন। পাল্টা জবাবে রাশিয়া থেকে এ বার ঠিক একই সংখ্যক মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রেমলিন। রাশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন দূতকে ডেকে বলে দেয়া হয়েছে, বন্ধ করে দেয়া হবে সেন্ট পিটার্সবার্গের মার্কিন দূতাবাসও। এর পরই হোয়াইট হাউস সরকারিভাবে বিবৃতি দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছে, মস্কোর এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। তবে বিষয়টি তারা তাদের মতো বুঝে নেবে। ঠা-া যুদ্ধের পরে এত গভীর দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে এই দুই দেশ আর জড়িয়ে পড়েছিল কি না, মনে করতে পারছেন না কেউই। যদিও রুশ বিদেশমন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত তারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিয়েছেন। শুধু কি আমেরিকা? রুশ সরকারের বহিষ্কারের খড়গ নেমে এসেছে ওলন্দাজ কূটনীতিকদের উপরও। ব্রিটেনকেও ক্রেমলিন হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, এক মাসের মধ্যে রাশিয়া থেকে ব্রিটিশ কূটনীতিকদের উপস্থিতি কমিয়ে ফেলতে হবে। এজন্য বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদেরও ডেকে পাঠিয়েছিল রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তলব পেয়ে সকাল থেকেই বিদেশ দফতরের অফিসে একের পর এক বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা এসে দেখা করেন। রুশ সরকার আরও জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যে সব দেশ ‘অনৈতিকভাবে’ বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নেবে ক্রেমলিন। যা শুনে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সারা স্যান্ডার্স বলেন, ‘এ থেকেই বোঝা যায় যে, এ বিষয়ে আলোচনার রাস্তাতেই হাঁটতে রাজি নয় মস্কো।’ যদিও সারা সম্ভবত ভুলে গেছেন রুশ কূটনৈতিক বহিষ্কারের আগে তারাও সেভাবে আলাপ আলোচনার অপেক্ষা করেননি। বিবেচনায় নেননি রুশ প্রতিবাদ। অন্যদিকে রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক শোধরানোর দিকেই নজর রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের। আর পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার এই সংঘাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকে। জাতিসংঘ মহাসচিব এ্যান্তেনিও গুতেরেজ সাংবাদিকদের কাছে ঠা-া যুদ্ধের আবহ ফিরে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। রুশ-মার্কিন এই কলহে ঠা-া যুদ্ধের আমলও ফিরে আসতে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করেছেন তিনি। পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে সিরিয়াতে মার্কিন জোটের হামলাকে কেন্দ্র করে। গত শুক্রবার রাত থেকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে তিনটি জায়গায় একযোগে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প যাকে বলছেন, ‘লক্ষ্য সম্পূর্ণ,।’ বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছে জর্জ বুশের কথা, ইরাক জয়ের আগেই যিনি বিমান থেকে বলেছিলেন, ‘লক্ষ্য সম্পূর্ণ!’। মনে রাখতে হবে, তখন ইরাকের পাশে ছিল না পুতিনের মতো শক্তিশালী মিত্র। এই হামলাকে সামনে রেখে ক্রেমলিনের তরফ থেকে রবিবার জানানো হয়েছে, ‘জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে পশ্চিমা দেশগুলো ইতোমধ্যেই সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে। নতুন করে হামলা হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলে রাশিয়া মনে করে।’ খুলে না বলা হলেও ‘বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা’ বলতে পুতিন কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না কারওরই। আক্রমণ ঠেকাতে জাতিসংঘে ভোট চেয়ে ব্যর্থ পুতিন মার্কিন বিরোধী জোট গঠনের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যেই। জানা গেছে, সিরিয়ায় মার্কিন জোটের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানির সঙ্গে কথা বলেছেন পুতিন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার আনা নিন্দা প্রস্তাবকে তেমন কেউ সমর্থন না করলেও, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চীন। ফলে ধীরে হলেও, সিরিয়া ইস্যুতে যেন আড়াআড়িভাবে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব। ৭ এপ্রিল দুমায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে নিজের দেশেরই সাধারণ মানুষজনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আসাদ যতই সে অভিযোগ অস্বীকার করুন না কেন, মানতে রাজি নয় হোয়াইট হাউস। রাশিয়ার উপর চাপ বাড়িয়ে মার্কিন প্রশাসনের দাবি, আসাদকে সাহায্য করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। অভিযোগ অবশ্য পুরনো। বাতাসে গুজব, এ অভিযোগে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারির কথাও বিবেচনা করছে মার্কিন প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না মস্কো। জানা গেছে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বেশ কিছু মার্কিন পণ্যের আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে পুতিন প্রশাসন। অনেকেই বলছেন এই চাপানউতোরকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে যে কোন সময়। তবে এখনও সে কথা বলার সময় আসেনি। বরং হুমকি-পাল্টা হুমকির পেছনে অন্য একটি চিত্র নিতে হবে বিবেচনায়। ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়ের পেছনে রাশিয়ার ভূমিকায় শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ট্রাম্পের ইমেজ। রাশিয়া সংযোগের অভিযোগ ঝেড়ে ফেলতে এখন তিনি মরিয়া। দেশে তাকে কেন্দ্র করে চলা তদন্ত থেকেও দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে চান তিনি। অন্যদিকে সদ্য প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিজয়ী পুতিনও নিজ দেশে আছেন নানাবিধ সমস্যায়। আছেন ইমেজ সঙ্কটে। দু’জনের সামনে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে সহজ পথ সেই পুরনো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। আর তাদের এই খেলায় মূল্য দিতে হচ্ছে সিরিয়ার মতো দেশগুলোর সাধরণ মানুষ, নারী-শিশুদের। এখানেই সভ্যতার সঙ্কট। [email protected]
×