
ভাসকুলার ডিজিজ এমন একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা শরীরের রক্তনালিগুলোর কার্যক্ষমতাকে বিঘ্নিত করে। এটি ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চলের রক্তপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে দেখা দিতে পারে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকলতা কিংবা পঙ্গুত্বসহ একাধিক জটিলতা। অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে এই রোগের লক্ষণ তেমন বোঝা না গেলেও একসময় তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
কীভাবে সৃষ্টি হয় ভাসকুলার ডিজিজ?
ভাসকুলার ডিজিজ মূলত ধমনী (artery), শিরা (vein) ও কেশিকাগুলো (capillary) আক্রান্ত করে। রক্তনালির অভ্যন্তরীণ আবরণে ক্ষত সৃষ্টি হলে বা চর্বি ও কোলেস্টেরল জমতে থাকলে ধীরে ধীরে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, স্থূলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং পরিবারে পূর্ব ইতিহাস থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ভাসকুলার ডিজিজের ধরন
ভিন্ন ভিন্ন রক্তনালি ও দেহাংশে প্রভাব বিস্তারকারী ভাসকুলার ডিজিজের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (PAD): পায়ের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে ক্ষত শুকাতে না চাওয়া বা হাঁটার সময় ব্যথা হতে পারে।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD): হৃদযন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি তৈরি করে।
ক্যারোটিড ডিজিজ: ঘাড়ের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যায়, যা স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ায়।
সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ: মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রোধ তৈরি হয়ে স্ট্রোক ঘটতে পারে।
পালমোনারি হাইপারটেনশন: ফুসফুসে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হয়।
রেটিনোপ্যাথি: চোখের রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়।
ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি: পায়ের শিরায় রক্ত জমে গিয়ে ফুলে যায় বা ব্যথা হয়।
রেনাল আর্টারি ডিজিজ: কিডনির রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কিডনি বিকলতা দেখা দিতে পারে।
রেনোডস ডিজিজ: ঠান্ডায় হাত-পায়ের আঙুলে হঠাৎ রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
ভাসকুলাইটিস: রক্তনালির প্রদাহ, যা লুপাস বা আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে হতে পারে।
ভ্যারিকোজ ভেইন: পায়ের শিরা ফুলে গিয়ে চোখে পড়ে, যদিও তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
অ্যানিউরিজম: রক্তনালির দেয়াল দুর্বল হয়ে ফেটে গিয়ে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হতে পারে।
লক্ষণ ও জটিলতা
ভাসকুলার ডিজিজের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর তীব্রতা বাড়ে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
পায়ের চামড়া শুষ্ক বা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া,ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া,হাঁটার সময় পায়ের পেশিতে ব্যথা,বুকে চাপ বা ব্যথা,শ্বাসকষ্ট,হঠাৎ দুর্বলতা, মাথা ঘোরা বা কথা জড়ানো (TIA)।
এ রোগ থেকে দেখা দিতে পারে ভয়াবহ জটিলতা যেমন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, গ্যাংগ্রিন, কিডনি বিকলতা কিংবা পালমোনারি এম্বোলিজম।
নির্ণয় পদ্ধতি
ভাসকুলার ডিজিজ নির্ণয়ের জন্য রোগীর ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা এবং বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
রক্তচাপ পরিমাপ,রক্তনালির শব্দ শোনা (ব্রুইট),পায়ের রঙ বা উষ্ণতায় পরিবর্তন,আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এমআরআই বা অ্যাঞ্জিওগ্রাফির মাধ্যমে রক্তনালির চিত্রায়ন,রক্তের কোলেস্টেরল, গ্লুকোজ, ইনফ্ল্যামেশন চিহ্নিতকারী পরীক্ষা।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
চিকিৎসার মূল লক্ষ্য রক্তনালির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও রোগের ঝুঁকি কমানো। চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
জীবনযাত্রার পরিবর্তন (ধূমপান বন্ধ, ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ)
ওষুধ (রক্তচাপ, কোলেস্টেরল বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে)
ব্লাড থিনার বা অ্যান্টি-অ্যারিদমিক ওষুধ
জটিল ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার যেমন বাইপাস, স্টেন্ট বসানো, প্ল্যাক অপসারণ ইত্যাদি
প্রতিরোধে করণীয়
ভাসকুলার ডিজিজ প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতন জীবনযাপন। প্রতিদিনের অভ্যাসে যেসব পরিবর্তন আনা উচিত:
ধূমপান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা,রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা,নিয়মিত ব্যায়াম,সুষম খাদ্য গ্রহণ,মানসিক চাপ কমানো,নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
ভাসকুলার ডিজিজ একটি নীরব বিপদ, যার প্রভাব পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে চললে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। একবার জটিলতা দেখা দিলে পরিস্থিতি দ্রুত গুরুতর হয়ে উঠতে পারে, তাই সচেতন থাকাই শ্রেয়।
সূত্র:https://tinyurl.com/mvvsks76
আফরোজা