
ছবি: সংগৃহীত
OCD কি?
OCD (Obsessive-Compulsive Disorder) মানে হলো "আবেশন ও বাধ্যতামূলক আচরণের রোগ"। এটি এক ধরনের মানসিক রোগ যেখানে কোনো চিন্তা বারবার মস্তিষ্কে এসে এক ধরনের মানসিক অস্বস্তি বা ভয় তৈরি করে (এটি হলো obsession) এবং সেই অস্বস্তি দূর করতে বারবার কিছু কাজ বা আচরণ করতে হয় (এটি হলো compulsion)।
জরিপ ও গবেষণা কী বলছে?
World Health Organization (WHO) অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতি ২০০ জন শিশুর মধ্যে অন্তত ১ জন কোনো না কোনোভাবে OCD-তে ভোগে।
AACAP (American Academy of Child & Adolescent Psychiatry) এর মতে, ১৪ বছরের নিচে প্রায় ৪%-১০% শিশু ক্লিনিক্যাল OCD উপসর্গে ভোগে।
বাংলাদেশে একটি বেসরকারি মনোরোগ পরামর্শ সেবায় ২০২৩ সালের জরিপে দেখা গেছে, শহরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে OCD সম্পর্কিত উপসর্গ ২৫% পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগই অচিহ্নিত থাকে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ:
১. ডা. তৌহিদা ফেরদৌসী (মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ), “শিশুরা নিজের ভয় বা চিন্তা প্রকাশ করতে পারে না বলে OCD তাদের আচরণে অদ্ভুত রূপে প্রকাশ পায়। অনেক সময় ধর্মীয় ভয় বা পবিত্রতা নিয়ে বাড়াবাড়ি OCD-এর রূপ ধারণ করে।”
২. ডা. মাসরুরুল হক (শিশু মনোরোগ চিকিৎসক), “অনেক অভিভাবক OCD-কে খেয়ালি মনে করে উপেক্ষা করেন। অথচ সময়মতো থেরাপি দিলে এটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।”
৩. ডা. আফরোজা নাসরিন (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট),“শিশুদের ক্ষেত্রে CBT (Cognitive Behavioral Therapy) অত্যন্ত কার্যকর। পরিবার যদি সহানুভূতিশীল হয়, শিশুর সুস্থতা অনেক দ্রুত হয়।”
শিশুদের মধ্যে OCD-এর লক্ষণ:
1. বারবার অযথা ভয় বা চিন্তা (যেমন: রোগ হবে, কেউ মারা যাবে, গুনাহ হয়ে যাচ্ছে)
2. একই কাজ বারবার করা (যেমন: বারবার থুথু ফেলা, হাত ধোয়া, দরজা চেক করা)
3. অশান্তি বা ভয়ের কারণে কান্নাকাটি করা
4. মনোযোগে সমস্যা, ক্লাসে পিছিয়ে পড়া
5. গোপনভাবে কিছু অভ্যাস লুকিয়ে রাখা
6. নিজের চিন্তা নিয়ে লজ্জা পাওয়া, কেউ জানলে অপমান হবে এই ভয়
OCD-এর কারণ:
1. জিনগত প্রভাব: পরিবারে কারও OCD থাকলে বাচ্চারও হওয়ার ঝুঁকি বেশি
2. মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য হ্রাস (বিশেষ করে serotonin-এর ঘাটতি)
3. চাপ বা ট্রমা: পারিবারিক অশান্তি, ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ইত্যাদি
4. পারিপার্শ্বিকতা: অতিরিক্ত কঠোর শাসন, ধর্মীয় ভয়, সঠিকভাবে না শেখানো ধর্মীয় ধারণা
নিচে তিনটি বাস্তব ঘটনার কথা বলা হলো:
1.সায়রা, ৭ বছর বয়সী শিশু, বারবার থুথু ফেলে, কারণ তার মনে হয় মুখে নাপাক কিছু লেগে আছে।
2.প্রজ্ঞা, ক্লাস ফোরে পড়ে, হঠাৎ কেঁদে বলে, “আমি আজ মরে যাবো।”
3.সিয়াম, ১০ বছরের শিশু, ভাবে সে আল্লাহকে গালি দিচ্ছে, অথচ সে কিছু বলে না। এই চিন্তায় সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
Obsession ও Compulsion – উদাহরণসহ ব্যাখ্যা:
সায়রার ঘটনা (থুথু ফেলা):
Obsession: মনে হয় মুখে নাপাক কিছু লেগে গেছে
Compulsion: বারবার থুথু ফেলা
বয়স অনুযায়ী: ৭-৯ বছরের শিশুরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এমন আচরণ করতে পারে
প্রজ্ঞার ঘটনা (মৃত্যুভয়):
Obsession: মনে হয়, সে হঠাৎ মারা যাবে
Compulsion: কান্নাকাটি, ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা
বয়স অনুযায়ী: ৮-১০ বছর বয়সে মৃত্যু, মা-বাবাকে হারানো ইত্যাদি চিন্তা OCD-তে পরিণত হতে পারে
সিয়ামের ঘটনা (ধর্মীয় চিন্তা):
Obsession: মনে হয়, সে আল্লাহকে গালি দিচ্ছে (যদিও ইচ্ছাকৃত নয়)
Compulsion: ক্ষমা চাওয়া, কান্নাকাটি, নামাজ বেশি পড়া
বয়স অনুযায়ী: ১১-১৪ বছর বয়সে ধর্মীয় ভয় বা অনুশোচনামূলক চিন্তা OCD হয়ে উঠতে পারে
বয়সভিত্তিক Obsession ও Compulsion-এর ধরন:
৫-৭ বছর: নাপাক হওয়া, গায়ে কিছু লাগা নিয়ে ভয় – বারবার হাত ধোয়া, মুখ মোছা, থুথু ফেলা
৮-১০ বছর: দুর্ঘটনা, মৃত্যু, মা-বাবাকে হারানো নিয়ে ভয় – দরজা চেক করা, অভিভাবকদের জড়িয়ে থাকা, ঘন ঘন জিজ্ঞাসা করা
১১-১৪ বছর: গুনাহ, নরক, খারাপ চিন্তা – নামাজ বাড়ানো, কান্নাকাটি, ক্ষমা চাওয়া, চিন্তা চেপে রাখা
করণীয়:
1. সতর্ক থাকুন: আচরণে পরিবর্তন দেখলে অবহেলা না করে খেয়াল করুন
2. ভয় না দেখিয়ে বোঝান: ধর্মীয় বা সামাজিক ভয় চাপিয়ে না দিয়ে শিশুকে যুক্তি দিয়ে বুঝান
3. ভালোবাসা ও নিরাপত্তা দিন: শিশুর পাশে থাকুন, তাদের দোষারোপ করবেন না
4. CBT থেরাপি দিন: শিশুদের ক্ষেত্রে Cognitive Behavioral Therapy খুবই কার্যকর
5. বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন: দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন
6. ধৈর্য ধরুন: OCD নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে, কিন্তু চিকিৎসাযোগ্য
শিশুদের OCD অনেক সময় “খেয়ালি” বা “অভ্যাস” মনে হলেও তা ভেতরে গভীর মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে। যত দ্রুত এটি ধরা যায়, তত দ্রুত প্রতিকার সম্ভব। অভিভাবকদের উচিত শিশুর আচরণকে বোঝা, সহানুভূতিশীল হওয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে শিশুরা OCD থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
Mily