ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

খোলা তেলের ফাঁদে প্রতিদিন: জানেন কি কীভাবে বিষ ঢুকছে আপনার শরীরে?

সোহাগ খান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ৩ জুন ২০২৫

খোলা তেলের ফাঁদে প্রতিদিন: জানেন কি কীভাবে বিষ ঢুকছে আপনার শরীরে?

ছবি: সংগৃহীত

রাস্তায় মুখরোচক খাবার খাচ্ছেন, অথচ ভাবছেন— ‘আমি তো খোলা তেল খাই না’। আপনি একা নন— পুরো শহরটাই এখন এই ভ্রান্ত আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে।

ঢাকার ব্যস্ত জীবনযাত্রায় মানুষ যেমন সচেতন, তেমনই অসচেতন। ঘরে বোতলজাত, ফোর্টিফায়েড তেল ছাড়া যেন রান্নাই হয় না। অথচ রেস্টুরেন্ট, ফুটপাথ বা কোচিংয়ের পাশের ফাস্টফুড থেকে শুরু করে মুখে দেওয়া প্রতিটি ‘বাহিরের খাবারে’ অজান্তেই ঢুকে পড়ছে সেই পুরনো, বারবার ব্যবহৃত, খোলা তেল— যেটাকে আপনি ঘরে ঢুকতেই দেন না।

‘খাই না’ বললেই কি বাঁচা যায়?

কেরানীগঞ্জ উপজেলার মেহেদী সাহেবের সংসারে সচেতনতার অভাব নেই। রান্নার সময় তেলের গায়ে লেখা ভিটামিন ‘এ’-এর ফোর্টিফিকেশন পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেন। কিন্তু লাঞ্চটা বাইরে খেতেই হয়। সময় নেই, পছন্দের ছোট রেস্টুরেন্টে গিয়ে অর্ডার দেন পরোটা আর ডিম ভাজি। তেলটা কোথা থেকে এলো— কখনো ভাবেন?

শুধু মেহেদী নন, উপজেলার কোন্ডা থেকে হযরতপুর পর্যন্ত অসংখ্য হোটেল, ফাস্টফুড শপ ও স্ন্যাকস কারখানায় প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে লেবেলহীন, অপরিশোধিত, বারবার ব্যবহৃত খোলা তেল। এসব তেলে নেই ভিটামিন ‘এ’, নেই উৎসের নিশ্চয়তা। তবে দাম কম। আর তাই লাভ বেশি।

জিভের সুখে শরীরের সর্বনাশ

স্ট্রিট ফুড প্রেমীরা খেয়াল করলেই দেখবেন, সেই প্রিয় বেগুনি বা নাগেটের স্বাদটা যেন কিছুটা ধোঁয়াটে, একটু বেশি তেলতেলে। কারণ, ওগুলো ভাজা হচ্ছে আগের দিনের বারবার গরম করা খোলা তেলে। ভোজ্যতেলে থাকা ভিটামিনগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। আর বদলে আসছে বিষাক্ত উপাদান।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তেল শরীরে জমে তৈরি করে নীরব রোগ— চোখে সমস্যা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনি বা লিভারে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। এমনকি তৈরি হতে পারে অকাল অন্ধত্ব, হৃদরোগ বা ক্যান্সারের ঝুঁকি।

শুধু আইন দিয়ে কী হবে, যদি বাস্তবায়নই না হয়?

বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালেই ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, যেসব তেল ঢুকে পড়ছে রেস্টুরেন্ট, স্ট্রিট ফুড বা মিষ্টির দোকানে— তার অধিকাংশই মানহীন এবং ফোর্টিফায়েড নয়।

বাজারে খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করার ঘোষণাও এসেছে। কিন্তু ড্রামে ভরা অন্ধকারাচ্ছন্ন তেল এখনও অবাধে ঢুকছে শহরের প্রতিটি খাবারে। আর তেলের গায়ে তো আর লেখা থাকে না— এটি কতবার গরম হয়েছে, বা এতে পুষ্টি আছে কি না!

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর পর্যন্ত বলছে—তেল খোলা হলে তার মান প্রমাণ করাই কঠিন। তাই অভিযান চালালেও দোষীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

চানাচুর থেকে চপ, শিশুখাদ্যেও লুকানো বিষ!

ঢাকার অদূরের কিছু স্ন্যাকস কারখানায় খোলা তেল ব্যবহার চলছে দিনের পর দিন। সেই তেলেই তৈরি হচ্ছে আপনার ছেলের প্রিয় চানাচুর, অথবা স্কুল ফেরত মেয়ের পছন্দের রোল। বোতলের পেছনে পুষ্টি তালিকা দেখে খাবার কিনলেও, রাস্তায় কিনে নেওয়া এই সব খাবারে তেলের উৎস জানার কোনো উপায় নেই।
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম এই সমস্যাকে বলেন ‘নীরব ঘাতক’। 

তিনি সতর্ক করে বলেন— এই খাবারগুলো শুধু সাময়িক স্বাদ নয়, বরং তৈরি করছে জটিল অসুস্থতা। কিডনি ফেলিওর, হেপাটাইটিস, এমনকি ক্যান্সারের মতো বিপজ্জনক রোগের জন্ম দিতে পারে এই ভোজ্যতেল।

সমাধানটা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামষ্টিকও

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, “আমাদের দেশে এমনকি বোতলজাত তেলেও অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু খোলা তেলের ব্যবহারে অবস্থা আরও ভয়াবহ।” তার মতে, আইন, সচেতনতা ও নজরদারি— এই তিনটি দিকেই ত্বরিত পদক্ষেপ দরকার।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, “খোলা তেলের বাজারজাত আইনত নিষিদ্ধ হলেও, কার্যকর বাস্তবায়ন না থাকায় আমরা এখনো এর ভয়াবহতা সামাল দিতে পারিনি।”
তাই প্রয়োজন—

  • রেস্টুরেন্ট ও দোকানে খোলা তেল ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ 

  • প্রতিটি তেলের উৎস, মান ও ফোর্টিফিকেশন যাচাই

  • ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা খাদ্য-গ্রেড প্যাকেজিংয়ে তেল ব্যবহার করতে 

  • ক্রেতা ও ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা— যেন জানেন, খোলা তেল মানে কেবল তেল নয়, একেকটি ভবিষ্যতের অসুখ

শেষ কথা

আমরা কি সত্যিই নিরাপদ? ঘরে যতই ‘ভালো তেল’ ব্যবহার করি না কেন, যদি বাইরে খাবার খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলি—তাহলে অসুখ ঠেকানো কঠিন। শহরের প্রতিটি চপ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চানাচুর কিংবা ডিমভাজিতে যদি ঢুকে পড়ে অস্বাস্থ্যকর খোলা তেল, তবে সচেতনতা শুধু ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।

তেল কি বোতলে, না ড্রামে? আপনি কি জানেন? যদি না জানেন, তবে খোলা তেলের অদৃশ্য বিষ আপনার দেহে ঠিকই ঢুকছে— আপনি মানেন বা না মানেন।

আবির

×