ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মোশন সিকনেস ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

ডাঃ সুমন কুমার বিশ্বাস

প্রকাশিত: ১৫:১২, ২০ মে ২০২৫

মোশন সিকনেস ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

ছবি: সংগৃহীত

মোশন সিকনেস হল এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি। তা কেমন? গাড়ি, নৌকা, ট্রেন, প্লেনে ভ্রমণ করার সময় কিছু ব্যক্তি বা বাচ্চা খুব অসুস্থ বোধ করেন। প্রশ্ন হল কোন ধরনের অসুস্থতা? তাঁরা বমি বমি ভাব অনুভব করতে পারেন বা বমিও হতে পারে। সঙ্গে থাকতে পারে মাথা ব্যথা। এই অবস্থাকে মোশন সিকনেস বলা হয়। এছাড়াও কিছু লোক নির্দিষ্ট ভিজ্যুয়াল অ্যাকটিভিটি থেকে যেমন ভিডিও গেম খেলা বা ঘূর্ণায়মান বস্তু দেখার কারণেও মোশন সিকনেসের মতোই সমস্যা অনুভব করেন। মোশন সিকনেস হঠাৎ শুরু হয় এবং রোগীর ঘাম বেরয় এমনকী শরীরে শীতল ভাব অনুভূত হয়। জাহাজে ভ্রমণের সময় মোশন সিকনেস সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যায়। একে বলে সি-সিকনেস।

কারা বেশি আক্রান্ত হয় ?
দেখা গিয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা মোশন সিকনেসের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। বহু শিশু গাড়িতে ভ্রমণ করার সময় মোশন সিকনেস অনুভব করে (যাকে কার সিকনেস বলে)। ৩ থেকে ১২ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে মোশন সিকনেসের প্রভাব বেশি দেখা যায়। আবার পুরুষদের তুলনায় মহিলারা এই সমস্যায় বেশি পড়েন। ‘মেনস্ট্রুয়েশন সাইকেল চলার সময় এবং গর্ভাবস্থায় মহিলারা গাড়িতে, ট্রেনে, বিমানে, জল জাহাজে ভ্রমণ করার সময় এই ধরনের উপসর্গ বেশি অনুভব করেন।

কারণ কী?
আমাদের কানের অন্দরে একটি অঙ্গ আছে যা দেহের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। আমরা যখন একটি চলন্ত গাড়িতে ভ্রমণ করি তখন গাড়ির গতি কখনও ধীর হয় আবার কখনও খুব দ্রুত হয়। এই গতির তারতম্যে কানের অন্দরের অঙ্গটি প্রভাবিত হতে পারে। ফলে মোশন সিকনেস হতে পারে।

কীভাবে হয়?
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আসলে আমরা যখন হাঁটি তখন চলার গতি প্রায় একইরকম থাকে। হাঁটার সময় চোখ, ত্বক, শরীরের পেশি এবং কানের অঙ্গটি একসঙ্গে ব্রেনে আমাদের দেহের গতি সম্পর্কে বার্তা পাঠায়। সকল প্রকার বার্তা একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে ব্রেন মোশন বা দেহের গতি বিবেচনা করে। এখন গাড়িতে চেপে যাওয়ার সময় আমাদের শরীর স্থির থাকলে ও দৃষ্টি কোনও একটি নির্দিষ্ট অংশে নিবদ্ধ থাকলেও কানের অঙ্গটি কিন্তু গাড়ির বেগ সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। অথচ যেহেতু শরীর ও চোখ স্থির থাকে তাই ব্রেনে গতির ব্যাপারে সঠিক বার্তা পৌঁছয় না। ব্রেন থেকে সঠিকভাবে বার্তাও অন্যান্য অঙ্গে পৌঁছয় না! ফলে শুরু হয় মোশন সিকনেসের উপসর্গ। একইরকম সমস্যা অনুভূত হতে পারে ভিডিও গেম খেলার সময়। কারণ চোখ গেমের সঙ্গে নড়াচড়া করে। অথচ শরীর স্থির থাকে। ভারসাম্যহীনতার কারণে আমরা অসুস্থ বোধ করি। অর্থাৎ এই অপ্রত্যাশিত সংকেতগুলি মস্তিষ্কে একটি বিভ্রান্তিকর বার্তার সৃষ্টি করে যার প্রভাবে মোশন সিকনেসের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। আবার মস্তিষ্ক যখন গতির নতুন প্যাটার্নের সঙ্গে
খাপ খাইয়ে নেয় তখন লক্ষণগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে মস্তিষ্কের বার্তা বহনকারী অ্যাসিটাইলকোলিন এবং ডোপামিন নামে দুটি নিউরোট্রান্সমিটার বা বিশেষ রাসায়নিক মোশন সিকনেস সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়া নিম্নলিখিত কারণগুলিও মোশন সিকনেসের আশঙ্কা বাড়ায়, যথা
১. মোশন সিকনেসের পারিবারিক ইতিহাস,
২. হরমোনের দ্বারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ,
৩. কানের ভিতরের ভারসাম্যের অঙ্গটির ব্যাধি,
৪. মেনস্ট্রুয়েশন,
৫. মাইগ্রেন বা টেনশন হেডেক,
৬. পারকিনসন রোগ,
৭. গর্ভাবস্থা ।
এছাড়া যাঁরা গাড়িতে ওঠার আগে অসুস্থ হতে পারেন ভেবে বেশি উদ্বিগ্ন হন তাঁদের মোশন সিকনেস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি থাকলে মোশন সিকনেসের কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ভারী খাবার খাওয়ার পরমুহূর্তে গাড়িতে ভ্রমণ করলেও দেখা দিতে পারে মোশন সিকনেস।nমোশন সিকনেসের লক্ষণ ও জটিলতা মোশন সিকনেসের সমস্যায় রোগীরা এক মুহূর্ত ভালো বোধ করেন আবার পরমুহূর্তেnএক বা একাধিক সমস্যা অনুভব করতে পারেন।

কী কী সমস্যা দেখা দেয়?
ঠান্ডা ঘাম, মাথা ঘোরা , ক্লান্তি ও দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, বিরক্তি, মনোনিবেশ করতে সমস্যা, মুখগহ্বরে লালা বৃদ্ধি, বমি বমি ভাব, বমিও হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যায় বা শ্বাসকষ্ট হয়, ডিহাইড্রেশন ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ। তবে মোশন সিকনেসের লক্ষণগুলি সাধারণত গাড়ির গতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে চলে যায়। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে সমস্যার সমাধান হতে ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। মোশন সিকনেস থেকে কোনও গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি হয় না। তবে প্রচুর পরিমাণে বমি হলে বা বমি বন্ধ না হলে ডিহাইড্রেশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মোশন সিকনেস নির্ণয়
কেবলমাত্র উপসর্গ এবং লক্ষণগুলির পর্যবেক্ষণ দ্বারা এবং রোগীর ‘চলমান' যানে থাকাকালীন যা যা সমস্যা দেখা যায় তা নির্ধারণ করেই মোশন সিকনেস নির্ণয় করা যায়।

মোশন সিকনেসের চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথিতে মোশন সিকনেসের চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু ওষুধ আছে, যার সফল প্রয়োগে এই অসুস্থতা থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুক্তি দিতে পারে। তবে মোশন সিকনেসে নিজে নিজে চিকিৎসা না করে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া একান্ত জরুরি। বিশেষ করে যদি রোগী গর্ভবতী হন, রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য, হার্টের সমস্যা থাকে, পেটের আলসার ন্যারো অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, বর্ধিত প্রস্টেট গ্ল্যান্ড ইত্যাদি রোগের ইতিহাস থাকে।

মোশন সিকনেসের প্রতিরোধ
নিম্নলিখিত ক্রিয়াগুলি মোশন সিকনেসে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দিতে পারে বা লক্ষণগুলি দেখা দিলেও অস্বস্তি কম করতে পারে। কাজেই যাঁরা গতি জনিত অসুস্থতায় ভুগছেন তাঁদের ভ্রমণের আগে বা ভ্রমণ চলাকালীন নিম্নলিখিত কাজগুলি
এড়ানো উচিত— অ্যালকোহল ও ধূমপান বর্জন, দুগ্ধজাত খাদ্য, লবণ, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, ভারী এবং চর্বিযুক্ত খাবার, মশলাদার বা অ্যাসিড উৎপাদক খাবার এড়িয়ে চলুন, অপ্রীতিকর গন্ধ বর্জন করুন। ভ্রমণকালে আশপাশ বা কাছের জিনিসগুলি পড়ার চেষ্টা করলে বা দেখার চেষ্টা করলে মোশন সিকনেস আরও খারাপ হতে পারে। সেজন্য দূরত্ব বা দিগন্তের বস্তুগুলিতে ফোকাস করা ভালো।

কী করবেন?
হালকা সহজপাচ্য খাদ্য খান, শর্করাজাতীয় খাদ্য খান, ভ্রমণের সময় আদা, পুদিনা, লেবুর রস বা ল্যাভেন্ডারের গন্ধে শ্বাস নিন, পিপারমিন্ট বা আদা দিয়ে তৈরি শক্ত ক্যান্ডি খান, প্রচুর জল পান করুন, ভ্রমণকালে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ুন, সম্ভব হলে চোখ বন্ধ করুন, ভ্রমণের সময় সামনের দিকে বা গাড়ি যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে মুখ করে বসা উচিত। এমনকী ট্রেনে, বিমানে সামনের সিটে বা উইং সেকশনে বসুন। নৌকায় ভ্রমণকালে সামনে বা মাঝখানে বসুন। জলজাহাজে সামনে বা মাঝখানে একটি কেবিন বুক করুন। যানে ভ্রমণকালে এমন একটি জায়গা বাছুন যেখানে ভালো বায়ু চলাচল করে। আকুপ্রেশার রিস্টব্যান্ড পরা এবং রেকটাল সাপোজিটরি ব্যবহার করলেও উপকার মেলে।

মোশন সিকনেসের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে বহু কার্যকরী ওষুধ আছে। তবে ওষুধ রোগীর মানসিক এবং শারীরিক লক্ষণ বিবেচনা করে নির্বাচন করলে তবেই উপযুক্ত ফল মেলে।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ
-ককুলাস ইন্ডিকা-৩০: মাথা ঘোরা সহ মোশন সিকনেসের একটি সেরা প্রতিকার এই ওষুধটি। গাড়ি বা নৌকায় চড়ার ফলে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা এবং বমির জন্য উপকারী।
-পেট্রলিয়াম-৩০: মাথা ব্যথা সহ মোশন সিকনেসের অন্যতম সেরা প্রতিকার। কিছু ব্যক্তি ভার্টিগো এবং অক্সিপিটাল লোরে (মাথার পিছনের দিকে) ব্যথা সহ ভয়ঙ্কর বমি বমি ভাব এবং বমির সমস্যায় ভোগেন। নৌকায় ও গাড়িতে চড়লেই বমি বমি ভাব দেখা দেয়। 
-ট্যাবেকাম-৩০: রোগী ফ্যাকাশে, ঠান্ডা ঘাম এবং ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গগুলিতে ভুগলে, বিশেষ করে হাত ও পা যখন ঠান্ডা হয়ে যায় এবং ঠান্ডা বাতাসে মোশন সিকনেসের লক্ষণগুলির উপশম হয়।
-বোরাক্স-৩০: প্লেন, জাহাজ বা যে কোনও গাড়ির নিম্নগামী গতিতে অনেকের বমি বমি ভাব বা বমি হয়। নিম্নগামী গতির ভয়ের বৈশিষ্ট্যযুক্ত লক্ষণ সহ গতির অসুস্থতার জন্য সর্বোত্তম বোরাক্স-৩০।
-কফিয়া ক্রড়া - ৩০: বমি করার প্রবল প্রবণতা ও মাইগ্রেনের সঙ্গে শ্লেষ্মাযুক্ত বমি হলে ওষুধটি রোগীকে দেওয়া যায়। মোট কথা মাথা ব্যথা সহ ক্রমাগত পেটের অসুস্থতা এবং মোশন সিকনেস থাকলে ওষুধটি প্রয়োগ করা যায়।
-পালসেটিলা-৩০: নৌকা বা জাহাজের ভ্রমণের সময় মোশন সিকনেস অনুভূত হলে, বদ্ধ জায়গায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা আরও খারাপ হলে, রোগী প্রফুল্ল কিন্তু সহজেই কান্নায় ভেঙে পড়লে, তৃষ্ণাহীনতা থাকলে এবং ডেকের খোলা বাতাসে বমি বমি ভাব কমলে ওষুধটি উপযুক্ত।
-স্ট্যাফিসাগ্রিয়া-৩০: বমি হওয়ার আগে মাথা ঘোরা এবং বমি বমি ভাব শুরু হলেই ওষুধটি প্রয়োগ করলে উপকার মেলে।
-বেলেডোনা-৩০: বিমানচালকদের বায়ু অসুস্থতার প্রতিরোধক হিসেবে দেওয়া হয় ওষুধটি। এছাড়া যাঁদের বিমানযাত্রা জনিত মোশন সিকনেস আছে তাঁরাও বিমানে চড়ার আগে ওষুধটি খেতে পারেন।
-কোকা-৩০: অধিক উচ্চতায় অসুস্থতা, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে রক্ত বমি হলে ওষুধটি প্রয়োগে উপকার লক্ষ করা যায়
-অ্যাকেলাইট-৩০: ভ্রমণকালে প্রচণ্ড ভীতির জন্য রোগী ছটফট করলে ও চিন্তান্বিত হলে ওষুধটি দেওয়া যায়
-ব্রায়োনিয়া-৩০: ভ্রমণকালে সামান্য নড়াচড়াতে এমনকী কথা বলাতেও বমি বমি ভাব এবং প্রচণ্ড জল পিপাসা বোধ থাকলে ও ওই ব্যক্তি যদি একদম চুপচাপ বসে থাকতে চায় তাহলে ওষুধটি প্রয়োগে উপকার মেলে।
উপরি উক্ত ওষুধগুলি ছাড়াও ইপিকাক, নাক্সভমিকা, আর্সেনিক, ক্যালি বাই ক্রোমিকাম, সিপিয়া ইত্যাদি হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগের সাফল্য মেলে।

লেখকঃ ডাঃ সুমন কুমার বিশ্বাস, বি.এইচ.এম.এস (কলকাতা) এম.পি.এইচ. (মুম্বাই) এম.ডি. (হায়দ্রাবাদ)

সাব্বির

×