ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব

ডা. মো. সেতাবুর রহমান

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ২৫ অক্টোবর ২০২২

স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব

অক্টোবর স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের মাস

স্তন ক্যান্সার নারীদের কাছে আতঙ্কের বিষয়। পুরুষের চেয়ে নারীদের স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। অনেক নারী নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। আবার সহজে কারও কাছে বলতে দ্বিধা বোধ করেন। ফলে তারা স্তন ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
অক্টোবর মাস স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস। এ মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে সচেতন করে তোলা সবারই উচিৎ।
স্তন ক্যান্সার কি
স্তন ক্যান্সার হলো কোষের অপরিণত বৃদ্ধি। স্তন কোষের অনিয়মিত বিভাজনের ফলে এটি টিউমার বা পি-ে পরিণত হয়। রক্তনালীর লাসিকার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
কেন হয়
অনেকগুলো কারণে স্তন ক্যান্সার হতে পারে। অতিরিক্ত ওজনও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। দেরিতে সন্তান গ্রহণ, সন্তান না থাকা, কিংবা সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি বা ফলমূলের চাইতে চর্বি ও প্রাণীজ আমিষ বেশি থাকলে এবং প্রসেসড ফুড বেশি খেলে স্তন ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ে। দীর্ঘদিন ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া বা হরমোনের ইনজেকশন নেয়া, স্তন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।

বয়স ৫০ বছর পর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। কারও যদি ১২ বছরের আগে ঋতুস্রাব হয় এবং দেরিতে মেনোপজ বা ঋতু বন্ধ হয়, তারাও এ ঝুঁকিতে থাকেন। স্তনের আকারের চেয়ে বড় মাপের ব্রা স্তনের টিস্যুগুলোকে ঠিকমত সাপোর্ট দিতে পারে না। আবার অতিরিক্ত ছোট বা টাইট ব্রা স্তনের তরলবাহী লসিকাগুলো কেটে ফেলতে পারে। এটাও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এছাড়া সারাক্ষণ ব্রা পরে থাকার কারণে ঘাম নির্গমনে বিগ্ন ঘটে ফলে আর্দ্রতা জমে। এ কারণে স্তন ক্যান্সারের হতে পারে! ডিওডোরেন্ট এলুমিনাম বেসড উপাদান থাকলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। অতিমাত্রায় অ্যালকোহল, তামাক সেবনের ফলেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। বংশে এর আগে কারও ব্রেস্ট বা ওভারি ক্যান্সার থাকলে বা বিএআরসিএ ১, ও বিএআরসি ২, জিন থাকলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
লক্ষণগুলো
ব্রেস্টফিডিং করাচ্ছেন না অথচ স্তনবৃন্ত থেকে অল্প অল্প দুধের মতো জলীয় পদার্থ নিঃসরণ হচ্ছে। অনেক সময় স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত পড়তেও দেখা যায়। কোনো র‌্যাশ ছাড়াই চুলকানির অনুভূতি, এটি স্তন ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ। স্তনে টিউমার থাকলে তা আশপাশের টিস্যুগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং এর ফলে স্তনে ফোলা ভাব দেখা যায়। কাঁধ এবং ঘাড়ের ব্যথাও ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ। কারণ এটি স্তন থেকে খুব সহজেই শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
স্তনবৃন্ত চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া, বেঁকে যাওয়া বা স্তনবৃন্তের আকার অসমান হয়ে যাওয়া ক্যান্সারের লক্ষণ। স্তনে ছোট ছোট ফুসকুড়ির মতো লাম্প হওয়া। এই ব্রেস্ট লাম্পগুলো অনেক সময় আন্ডারআর্ম বা কলার বোনের তলাতেও দেখা যায়, যেগুলো টিপলে শক্ত অনুভূত হয়। অন্তর্বাস পরে থাকার সময় যদি ঘর্ষণ অনুভব করেন, এবং ব্যথা লাগে তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
স্তনবৃন্ত খুবই সংবেদনশীল অংশ। যদি দেখেন স্তনবৃন্ত স্পর্শ করার পরও তেমন কোনো অনুভূতি হচ্ছে না, তবে তা ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ। স্তনের ত্বকে লালচে আভা এবং অমসুণতা দেখা দেওয়া। এটা এডভান্সড ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ। স্তনবৃন্তে বিশেষ কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়, যেমন- স্তনবৃন্ত দেবে যাওয়া, চুলকানি, জ্বালা পোড়া, চামড়া ওঠা, ক্ষত কিংবা ঘা এর উপস্থিতি।
কিভাবে পরীক্ষা করবেন
বিশ বছরের পর থেকে প্রত্যেক নারীর উচিৎ প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে নিজের স্তন পরীক্ষা করা। মাসিক শুরুর ৫-৭ দিন পর এই পরীক্ষা করার উপযুক্ত সময়। কারণ তখন স্তন নরম ও কম ব্যথা থাকে।
১. আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্তনকে চারটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি অংশের অভ্যন্তরে কোন চাকা বা দলার মতো আছে কিনা তা অনুভব করুন। হাত দুটো পাশে রাখুন, এবং ভালো করে লক্ষ্য করুন স্তনের চামড়ায় কোনো পরিবর্তন কিংবা আকারে কোনো তারতম্য এসেছে কি না।

এবার দুই হাত কোমরে রেখে বুক সামনের দিকে চিতিয়ে দেখুন স্তনে কোনো ধরনের দাগ, ঘা কিংবা গর্ত আছে কি না। এবার হাত দুটো উঁচু করে আরও একবার পরীক্ষা করুন। এক্ষেত্রে আপনি নিপল থেকে শুরু করে বৃত্তাকারভাবে বাহিরের দিকে ওপর-নিচ করে সম্পূর্ণ স্তন পরীক্ষা করতে পারেন। আপনার বাম হাত দিয়ে ডান পাশের ও ডান হাত দিয়ে বাম পাশের স্তন পরীক্ষা করুন।
২. গোসলের আগে একটি হাত মাথায় রাখুন। আরেকটি হাতের আঙ্গুল দিয়ে কলার বোনের কয়েক ইঞ্চি নিচ থেকে একদম বগল পর্যন্ত চেপে দেখুন, পুরো স্তনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চক্রাকারে পরীক্ষা করতে থাকুন, প্রথমে হালকাভাবে, পরে একটু চাপ দিয়ে স্তনের টিস্যুগুলো পরীক্ষা করুন।
৩. শুয়ে শুয়ে পরীক্ষা বিছানায় শুয়ে ডান দিকের কাঁধের ওপর একটি বালিশ রাখুন। ডান হাত মাথার পেছনে দিন। এবার বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে চক্রাকারে ডান পাশের স্তন পুরোটা পরীক্ষা করুন। স্তনবৃন্ত চেপে ধরে নিশ্চিত হয়ে নিন কোনো তরল নিঃসৃত হচ্ছে কি না, কিংবা কোনো ধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপারে আছে কি না। একইভাবে এবার বাম পাশের স্তন পরীক্ষা করুন।
রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা
যাদের পরিবারে কারও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে এমন ঘটনা আছে। তাদের হাসপাতালে গিয়ে ম্যামোগ্রাম করতে হবে। ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের নির্ধারিত বিরতিতে এক, দুই বা তিন বছর পরপর নিয়মিতভাবে ম্যামোগ্রাম করা হয়। এছাড়া ইমেজিং পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে আলট্রাসাউন্ড, এমআরআই (গজও) এবং সার্জিক্যাল টেস্টের মধ্যে বায়োপসি (নরঢ়ংু) অন্যতম। সিইএ (ঈঊঅ), সিএ-১৫-৩ (ঈঅ-১৫-৩), বা সিএ-২৭.২৯ টেস্ট এবং রক্তের সিবিসি (ঈইঈ) পরীক্ষারও প্রয়োজন পড়ে।
চিকিৎসা
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় সার্জারি প্রথম উপায়। লাম্পেক্টমি অর্থাৎ টিউমার ও তার আশপাশের কিছু টিস্যু কেটে এই অপারেশন করা হয়। মাস্টেক্টমি এই অপারেশন-এ স্তন এবং এর নিচের মাংসপেশি, বগলের লসিকাগ্রন্থিসহ আনুষঙ্গিক আক্রান্ত টিস্যু কেটে ফেলা হয় কিংবা সম্পূর্ণ স্তন কেটে ফেলা হয়। কোনো কোনো রোগীর স্তনের চামড়া সংরক্ষণ করে বিকল্পভাবে স্তন পুনর্গঠন করা হয়।

শরীরের অন্য জায়গা থেকে মাংসপেশি কেটে নিয়ে স্তনের আকার করে স্তনের জায়গায় পুনঃস্থাপন করার মাধ্যমে এটি করা হয়। র‌্যাডিক্যাল ম্যাস্টেক্টমির মাধ্যমে বুকের দেয়ালের মাংসপেশি, বগলের নিচে লিম্ফনোডসহ পুরো স্তন কেটে বাদ দেয়া হয়। ক্যান্সার কোষ লিম্ফনোডে পৌঁছে তার মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। সেন্টিনেল নোড বায়োপসির মাধ্যমে লিম্ফনোড সরিয়ে ফেলা হয়। একে বলা হয় অ্যাক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশন।
রেডিও থেরাপি হলো তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগ করে শরীরের ক্যান্সারের কোষ নির্মূল করা হয়। তাছাড়া দেহের অভ্যন্তরে তেজস্ক্রিয় পদার্থ স্থাপন করেও চিকিৎসা করা যায়।
সাধারণত স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় অপারেশন পরবর্তী সময়ে অ্যাডভান্স কেমোথেরাপি দেওয়া হয়ে থাকে। এতে ক্যান্সার কোষের পুনরাবির্ভাবের ঝুঁকি থাকে না।

তবে অনেক ক্ষেত্রে টিউমার বেশি বড় থাকলে কেমোথেরাপি (ঘবড় অফলাঁধহঃ) অপারেশনের আগে নিতে হতে পারে। সাধারণত ৬-৮টি ডোজ (প্রতি মাসে একটি করে) বা রক্তনালির মাধ্যমে ইনজেকশন দেওয়া হয়। কেমোথেরাপি ইস্ট্রোজেন তৈরি বন্ধ করতে সাহায্য করে। ইস্ট্রোজেন স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
বায়োলজিক্যাল ইম্যুনোথেরাপি সার্জারি, রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপি তুলনায় বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি। বায়ো-ইম্যুনোথেরাপির মাধ্যমে রোগীর রক্ত সংগ্রহ করে, ইমিউনোলজিক সেল (ডিসি-সিআইকে) তৈরি করা হয়। এরপর এ সংগৃহীত রক্ত রোগীর শরীরে পুনরায় প্রবেশ করিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এটি ক্যান্সার কোষকে সরাসরি ধ্বংস করে মেটাস্টিসিস রোধ করে থাকে।

লেখক :  সিনিয়র কনসালটেন্ট, সার্জিক্যাল অনকোলজি
ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার : ২৬, গ্রীন রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা। হট লাইন : ০৯৬৬৬৭১০০০১, ১০৬৬৬

×