ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শালবন বিহার: সময়ের দেয়ালে খোদাই করা এক নীরব সভ্যতা

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ৩ জুন ২০২৫

শালবন বিহার: সময়ের দেয়ালে খোদাই করা এক নীরব সভ্যতা

ছবি: সংগৃহীত

ময়নামতির উঁচু-নিচু টিলা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে আজও যেন ভেসে আসে ধূপের গন্ধ। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেবল একটি শব্দই কানে বাজে—“ধ্যান”। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ইতিহাস—শালবন বিহার। কুমিল্লার বুকের ভেতরে যেন সময়ের এক গোপন অধ্যায় লুকিয়ে রেখেছে এই প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারটি।

আজ যেখানে আমরা মোবাইলে ছবি তুলি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেলফি দিই—এক সময় সেখানে বুদ্ধের মূর্তির সামনে ধ্যান করত শিষ্যরা। কক্ষগুলোতে প্রতিদিন চলত ধর্ম পাঠ, জ্ঞানচর্চা, আর প্রার্থনার নীরবতা। শালবনের ছায়ায় তারা খুঁজত মুক্তির পথ—অর্জন করত আত্মজ্ঞান।


এক প্রাচীন রাজ্যের নিঃশব্দ উত্তরাধিকার

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটা যখন এখন এত প্রচলিত, তখন ভাবা যায় না যে বাংলার মাটিতেই ছিল এক সময়ের বিশ্বমানের জ্ঞান কেন্দ্র। ইতিহাস বলছে, অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীতে পাল রাজবংশের রাজা ভবদেব নির্মাণ করেন এই বিহারটি। ১১৫টি কক্ষ, চারপাশে বারান্দা, কেন্দ্রস্থলে বিশাল মন্দির—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র।

এখানে বসবাস করতেন শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষু। তারা শুধু ধর্মই নয়, অধ্যয়ন করতেন যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা ও সাহিত্যের মতো বিষয়। এক অর্থে এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়।


ইটের স্তূপে লুকিয়ে থাকা শতাব্দীর গল্প

যারা শালবন বিহারে আসেন, তারা দেখে লালচে ইটের স্তম্ভ, কিছু খণ্ডিত ঘর, আর ছোট একটি সাইনবোর্ড। কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল এক ইতিহাস। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে বেরিয়ে এসেছে ধাতব বুদ্ধমূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, তাম্রলিপি ও প্রাচীন ব্যবহার্য বস্তু—যা আজ ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষিত।

এসব নিদর্শন নিঃশব্দে বলে, “আমরা ছিলাম, আমরা কিছু গড়েছিলাম—যার চর্চা আজ নেই, অথচ প্রয়োজন আগের চেয়েও বেশি।”


আজকের পর্যটক, অতীতের সন্ধানী

প্রতিদিনই শত শত পর্যটক আসে এখানে। কেউ আসে শুধু সময় কাটাতে, কেউ ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার আশায়। কেউ জানে না কাকে দেখছে, কেবল ছবি তোলে। আবার কেউ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে—হয়তো তাদের কল্পনায় তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুর ধ্যান, মন্ত্রের শব্দ, ঘণ্টার ধ্বনি বাজতে থাকে।

শালবন বিহার যেন এমনই এক জায়গা—যেখানে দাঁড়ালে সময় কিছুক্ষণ থেমে যায়, আর মাটি থেকে উঠে আসে অতীতের ধ্বনি।


ইতিহাস শুধু বইয়ে নয়, নিঃশ্বাসে থাকা দরকার

আমরা এখনো অনেক কিছু সংরক্ষণ করতে পারিনি, হারিয়েছি অনেক নিদর্শন, ভুলে গেছি অনেক নাম। কিন্তু শালবন বিহার এখনো দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা একটি সভ্যতার উত্তরসূরি। যে সভ্যতা ধ্যান জানত, জ্ঞান জানত, সহনশীলতা জানত।

আজ যখন সভ্যতা ব্যস্ত, অস্থির, অসহিষ্ণু—তখন এই বিহার আমাদের শিক্ষা দিতে পারে নীরবতাতেই রয়েছে সব উত্তরের বীজ।


শালবন বিহার কেবল প্রত্নতত্ত্ব নয়, এটি আত্মার সাথে অতীতের যোগাযোগের এক সেতু। একদিন যে জায়গায় জ্ঞান উৎপন্ন হতো, আজ সেখানেই আমরা দাঁড়াই স্মৃতির মুখোমুখি হয়ে। ইতিহাসকে সংরক্ষণ মানে শুধু ইট রক্ষা করা নয়—মানুষের ভেতরের শ্রদ্ধাবোধ, কৃতজ্ঞতা আর আত্মপরিচয়ও রক্ষা করা।

কুমিল্লার শালবন বিহার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—একটা জাতি কেবল প্রযুক্তি বা অর্থনীতিতে বড় হয় না, সে বড় হয় তার শিকড় চিনে, সেই শিকড় আঁকড়ে ধরে।

Mily

×