ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আধুনিক যন্ত্রপাতি-প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ঢেঁকি

মো. সাইফুল ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মধুপুর, টাঙ্গাইল 

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৯:৫৪, ৩ জুন ২০২৫

আধুনিক যন্ত্রপাতি-প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ঢেঁকি

ছবি: গণমাধ্যমকর্মী মো. সাইফুল ইসলামের বাড়িতে থাকা ঢেঁকি। প্রায় অচলাবস্থায় পড়ে আছে।

আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে শহর থেকে গ্রামে। মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে নানা ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি। একইসাথে নিত্যদিনই ব্যবহৃত হচ্ছে নানা রকম প্রযুক্তি। এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য; এই আধুনিক যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে গ্রামের সেই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। যা আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না একদমই।

এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রামগঞ্জে ধান ভানা, চাল তৈরি, গুঁড়ি কোটা, চিড়া তৈরি, মশলাপাতি ভাঙানোসহ বিভিন্ন কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো ঢেঁকি। ঢেঁকির ধুপুর-ধাপুর শব্দে মুখরিত ছিল গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু এখন ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির সেই শব্দ আর শোনা যায় না। কাঠের ঢেঁকি এখন গ্রামীণ জনপদের বিলুপ্ত প্রায়।

বিশেষ করে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কৃষক ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষাণীদের ঘরে ধান থেকে নতুন চাল ও চালের গুঁড়া করার ধুম পড়ে যেতো। তখন চাল দিয়ে পিঠা-পুলি, ফিরনি-পায়েস তৈরি করা হতো। চলতো আড্ডা-আয়োজন, উৎসবমুখর পরিবেশ।

মধুপুরের প্রবীণ কৃষক-কৃষাণীদের ভাষ্যমতে, সত্তর দশকে প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়োর পিঠার গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঢেঁকি তৈরি করা হতো বরই, বাবলা ও জামগাছের কাঠ দিয়ে। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য, আর পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু। মাথায় বসানো হতো এক হাত পরিমাণের কাঠের দস্তা। দস্তার মাথায় লাগানো থাকে লোহার গুলা। এর মুখ যে নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে সে স্থানকে গড় বলে। এই গড়ে ভেজানো চালে পাড় দিয়ে তৈরি করা হয় চালের গুঁড়া।ঢেঁকিতে ধান বা চাল মাড়াই করতে কমপক্ষে তিনজন মানুষের প্রয়োজন হয়। পেছনের লেজবিশিষ্ট পুরু অংশে এক বা দুজন পা দিয়ে তালে তালে চাপ দিলে দস্তা সজোরে গরের ভেতর ধান বা চালের ওপর আঘাত করে। তবে দস্তার ওঠানামার ছান্দিক তালে তালে আরও একজন নারী ধান-চাল মাড়াই করতে সাহায্য করে। 

জানা যায়, ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া আর আলি দেওয়ার মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে ঘটতে পারে ছন্দপতন। ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে অনেকের হাতে আঘাত লেগেছে, আঙুল ভেঙেছে। পাড়াগাঁয়ে প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা যায় ঢেঁকিতে ধান ভেনে আটা তৈরির রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। তখন বধূরা ঢেঁকিতে কাজ করতো রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। একসময় মানুষ ঢেঁকিতে ধান ও চাল ভেনে চিড়া-আটা তৈরি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত হতো বাংলার জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ শোনা যায় না। ঢেঁকি এখন দাদি-নানিদের স্মৃতির গল্পে পাওয়া যায়।

মধুপুরের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ গ্রামে এখন আর ঢেঁকির দেখা মেলে না। কালের বিবর্তনে ঢেঁকি এখন শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে। দিন দিন ঢেঁকি বিলুপ্ত হলেও একে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে বেরীবাইদ ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের গণমাধ্যমকর্মী এ প্রতিবেদকের বাড়িসহ আরও কয়েকটি গ্রামে-পাড়া-মহল্লায় ঢেঁকির দেখা মিলেছে।

ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য, স্মৃতি বহনে, বাড়ির আশপাশের লোকজনের সুবিধার্থে গুঁড়ো তৈরি করার জন্য এ ঢেঁকি রাখা হয়েছে। নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করার জন্য তার বাড়িতে আসেন অনেকে।

এক কৃষাণী জানান, বিয়ের পর থেকেই ঢেঁকি দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য মাড়াই করেছি। আগে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ঢেঁকিতে চালের আটা তৈরি করতে আসতো। কিন্তু এখন আর তেমন কেউ আসে না। এখন সবাই মেশিনে চাল মাড়াই করে।

এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. জুবায়ের হোসেন বলেন, আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের কিছু ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে।। এসব ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে ঢেঁকি। আগামী প্রজন্ম যাতে বাংলার এসব সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলবন্ধন স্থাপন করতে পারে, সেজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা জরুরি। তা না হলে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা গ্রামের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে না।

আবির

×